এশিয়ার ন্যাটো গঠনের চেষ্টা কী ভেস্তে যাচ্ছে

ইলাস্ট্রেশন করেছেন লিও রুই - গ্লোবাল টাইমস

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ১৮ অক্টোবর ২০২০, ১৪:৪৬

জাপানের রাজধানী টোকিওতে গত ৬ অক্টোবর বৈঠকে বসেন 'চতুষ্টয়' নামে পরিচিত চার ক্ষমতাধর দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। বৈঠকে তাঁরা চার দেশের নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলেন। এটা ছিল তাদের এ ধরনের দ্বিতীয় বৈঠক। বৈঠকে যোগ দেন অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেরিস পেন, ভারতের সুব্রামনিয়াম জয়শঙ্কর, জাপানের তোশিমিতসু মতেগি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাইক পম্পেও। চার দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের এ বৈঠক নিয়ে ছিল অনেক গুঞ্জন - কী হয় এতে, কী সিদ্ধান্ত নেন পররাষ্ট্রমন্ত্রীগণ। কিন্তু কাজের বেলায় দেখা গেলো, এ রকম একটি হাই লেভেল মিটিঙয়ের পর একটি যুক্ত বিবৃতি দিতেও ব্যর্থ হয়েছেন তারা।

প্রভাবশালী চার দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের এ অপারগতাকে ভালোভাবে নেননি রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেই। তারা এ ব্যর্থতার সমালোচনা করেছেন। এছাড়া একে একটি স্থায়ী সংস্থার রূপ দিতেও তাদের আগ্রহী বলে মনে হয়নি। সব মিলিয়ে বৈঠকটি হয়ে গেছে যেন সাধারণ একটি দেখা-সাক্ষাতের মতোই।

পরে অবশ্য চার দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ ব্যাপারে পৃথক বিবৃতি দেয়া হয়। এসব বিবৃতি পড়ে অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকই ভাবছেন, সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর কাছে এ 'চতুষ্টয়ের' গুরুত্ব ক্রমেই কমে আসছে।

এ বৈঠকটি আসলে হওয়ার কথা ছিল গত বছর সেপ্টেম্বরে; নয়া দিল্লিতে। কিন্তু পরে অজ্ঞাত কারণে ভারত বৈঠকটি আয়োজনে অনিচ্ছা প্রকাশ করলে এর স্থান-কাল পরিবর্তন করা হয়। কথা ছিল, বৈঠকটি হবে টু প্লাস টু মিনিস্ট্রিয়াল ফরম্যাটে। অর্থাৎ প্রত্যেক দেশের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীগণ বৈঠকে যোগ দেবেন। চলতি সপ্তাহে টোকিওতে অনুষ্ঠিত বৈঠকের চাইতে সেটি আরো ব্যাপক হবে বলেই ধারণা করা হয়েছিল।

আরো লক্ষ্যণীয় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছিল এ চতুষ্টয় হোক 'এশিয়ান ন্যাটো', যা দিয়ে চীনকে ঠেকানো যাবে। তাদের ইচ্ছা ছিল, এ চার দেশের অলিখিত জোটকে সকল সদস্য দেশের একটা মিলিত প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় রূপ দেয়ার। তাহলে এর যে-কোনো সদস্য দেশ আক্রান্ত হলেই বাকি দেশগুলো তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসবে; যেমনটা আছে ন্যাটোর বেলায়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ ইচ্ছা ও উদ্যোগকে অনেক পর্যবেক্ষকই দেখছেন চার দেশীয় জোটকে চূড়ান্ত পর্যায়ে 'এশিয়ান ন্যাটো'তে রূপান্তরের চেষ্টা হিসেবে। কিন্তু টোকিও বৈঠকের পর এতে অংশগ্রহণকারীরা একটি যুক্ত বিবৃতি প্রকাশ করতেও যখন ব্যর্থ হলেন, তখন বোঝা গেল, চতুষ্টয়কে 'এশিয়ান ন্যাটো' বানানো এবং তা দিয়ে চীনকে ঠেকানোর মার্কিন খায়েশ আপাতত মাঠে মারা গেছে।

এ চতুষ্টয়কে যথেষ্ট গুরুত্ব না-দেয়ার পক্ষে এর প্রত্যেক সদস্য দেশের অনেক যুক্তি আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসনের ওপর তার নীতি পরিবর্তনের জন্য ব্যাপক চাপ রয়েছে। কেননা, চীনের সাথে বাণিজ্য ও প্রযুক্তিযুদ্ধে ক্রমাগত হেরেই চলেছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষজ্ঞরা প্রকাশ্যেই বলছেন, চীনের সাথে প্রযুক্তিযুদ্ধে টিকতে পারবে না মার্কিন চিপ ইন্ডাস্ট্রি।

আগামী ৩ নভেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনবিরোধী যেসব আওয়াজ দিয়ে চলেছেন, সেসবও ভোটারদের তেমন আকর্ষণ করছে বলে মনে হচ্ছে না। কেননা, চীনের সাথে বাণিজ্য-বৈষম্য কমানোর কোনো টেকসই ও কার্যকর ব্যবস্থা তিনি নিতে পারেননি। এছাড়া মার্কিনীদের কাছ থেকে চীন যেসব চাকরি চীন 'ছিনিয়ে নিয়েছে' বলে তিনি দাবি করেন, সেগুলো উদ্ধারেও সফল হননি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।

মার্কিন ভোটাররা এখন ভালোভাবেই বুঝতে পারছেন, টুইটার ওয়ালে চীনের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের কথার লড়াই আমেরিকার আসল অর্থনৈতিক সমস্যাবলী সমাধানে কোনো কাজেই আসেনি। বরং দু' দেশের বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে মার্কিন নাগরিকরা পাচ্ছে ''মোর পেইন দ্যান গেইন'' অর্থাৎ প্রাপ্তির চাইতে বেদনা বেশি। সেটা হলো এ রকম - ২০১৯ সালে চীনা পণ্যের ওপর ট্রাম্প ট্যারিফ আরোপের ফলে প্রতিটি মার্কিন পরিবারকে মাসে গড়ে এক হাজার ডলার বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে।

চীনা পণ্যের ওপর ট্রাম্প প্রশাসনের এ অতিরিক্ত ট্যারিফ আরোপের বিরুদ্ধে সা¤প্রতিক সপ্তাহগুলোতে সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি মার্কিন কম্পানি আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে। এতেই পরিষ্কার বোঝা যায়, চীনের সাথে ট্রাম্পের অদূরদর্শী বাণিজ্যযুদ্ধে মার্কিন ব্যবসায়ীমহল কতোটা ক্ষিপ্ত।

চীনের সাথে ট্রাম্পের বাণিজ্য ও প্রযুক্তিযুদ্ধ যতোটা সুফল আনবে বলে ভাবা হয়েছিল, অপ্রত্যাশিতভাবে তার চাইতে বেশি খারাপ ফল বয়ে আনায় ট্রাম্পের জনপ্রিয়তায় ধ্বস নামতে থাকে। এখন এটা পরিষ্কার যে, আসন্ন নির্বাচনে ট্রাম্প নিশ্চিতভাবেই হারতে চলেছেন।

মনে করা হচ্ছে, ট্রাম্প নিজেও এখন বুঝতে পারছেন যে, চীনের সাথে বাণিজ্য ও প্রযুক্তিযুদ্ধ তাঁর হাতে নতুন করে হোয়াইট হাউসের চাবি তুলে দেবে না। ট্রাম্প টিম তাই এখন তাদের চীন নীতিতে কিছু সংশোধনী আনার কথা ভাবছে। ভাবছে এমন কিছু ব্যবস্থা নেয়ার কথা, যাতে করে প্রতিশোধ হিসেবে চীন যেন মার্কিন অর্থনীতির কোনো ক্ষতি অন্তত করতে না-পারে। এদিকে চীন আগামী ২০৬০ সালের মধ্যে 'সবুজ অর্থনীতি' অর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটাও একটা একটা সতর্কবার্তা ।

সদ্যসমাপ্ত টোকিও বৈঠকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও যদিও যথারীতি চীনের নিন্দা করেছেন, কিন্তু পরে মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের বিবৃতিতে এটা পরিষ্কার করে দেয়া হয় যে, তারা এ মুহূর্তে চতুষ্টয়কে খুব গুরুত্ব দিচ্ছে না।

অস্ট্রেলিয়া যদিও টোকিও বৈঠকে যোগ দিয়েছে, তবে তার মানে এই নয় যে তারা খুশিমনে গিয়েছে। আসলে তারা আমেরিকার প্রবল চাপ ঠেকাতে না-পেরেই ওই বৈঠকে যোগ দেয়। এখন চীন যদি প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেয়, তাহলে অস্ট্রেলিয়ান অর্থনীতির বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। চীন চাইলে অস্ট্রেলিয়া থেকে খামারজাত পণ্য, মদ, খনিজ দ্রব্য, কয়লা ও প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে। অস্ট্রেলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চীনা শিক্ষার্থীদের ভর্তি এবং চীনা পর্যটকদের অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ বন্ধ করে দিতে পারে। বলা ভালো যে, চীন ইতিমধ্যেই অস্ট্রেলিয়া থেকে গরুর গোস্ত ও বার্লি আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে।

কাজেই দেশটি যদি চতুষ্টয়ে গা ছাড়া দেয়, তাকে অযৌক্তিক বলা যাবে না। চার দেশের এ অঘোষিত জোট যদিও জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে-র মাথা থেকেই এসেছে, তা সত্তে¡ও জাপান অকারণে চীনকে অসন্তুষ্ট করার ঝুঁকি নিতে চায় না। তারা চায় না জাপানের হাই-টেক কম্পানিগুলো চীনের বাজারে তাদের ব্যবসা হারাক।

বাকি রইলো ভারত। এ দেশটি আছে প্রচন্ড চাপের মধ্যে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যদিও সুস্পষ্ট পরিকল্পনা রয়েছে চার দেশীয় মৈত্রীকে ''এশিয়ান ন্যাটো''তে রূপ দেয়ার, ভারত কিন্তু এ পরিকল্পনার ব্যাপারে খুব-একটা উৎসাহী নয়। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর বিভিন্ন সময় বলেছেন যে ভারত কখনোই কোনো সামরিক জোটে যোগ দেবে না।

ভারত আশা করেছিল, কোভিড-১৯ অতিমারীর প্রবল ধাক্কায় মার্চ বা এপ্রিলের মধ্যেই চীনের অর্থনীতি অচল হয়ে পড়বে। আর তারা ১৯৬২ সালের যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে পারবে। ভারত আরো মনে করেছিল, মার্কিন সাহায্য নিয়ে চীনের অর্থনৈতিক, সামরিক ও কৌশলগত অগ্রগতি থামিয়ে দেয়া যাবে।

ভারতের ধারণাগুলো সত্য হয়নি। মার্চ মাস শেষ হওয়ার আগেই করোনা দানবকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে চীন। পক্ষান্তরে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতে মে ও জুন মাসেও প্রবল আঘাত হানে এ মহামারী। এ আঘাতে উভয় দেশের অর্থনীতি অপ্রত্যাশিত মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এদিকে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে চীন ও ভারতের নেতাদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক শীর্ষ বৈঠকে যেসব চুক্তি ও সমঝোতা হয় তা বাস্তবায়নের জন্য ভারতকে গত মে মাস থেকে ক্রমাগত চাপ দিয়ে আসছে চীন।

হিমালয় অঞ্চলে শীত আসি-আসি করছে। এ নিয়ে ভারতের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। সিয়াচেন হিমবাহে শত্রুর গুলিতে ভারতের যত সৈন্য মারা যায়, তার পাঁচ গুণ বেশি মরে শীতের প্রকোপে। এটা ভারতের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ। লাদাখেও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সৈন্য কমাতে চায় ভারত।

এসব কারণেই গত বছর নয়া দিল্লিতে চার দেশীয় মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক আয়োজন থেকে পিছিয়ে আসে ভারত। এর মধ্য দিয়ে চীনের সাথে ইতিপূর্বে উপনীত একটি সমঝোতা বাস্তবায়নে আগ্রহ দেখায় ভারত। গত বছর সেপ্টেম্বরে মস্কোতে সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের সাইডলাইনে এ সমঝোতা হয়। এতে বলা হয়, চীন-ভারত সম্পর্ক উন্নয়নের গাইডলাইন হিসেবে উভয় দেশ তাদের নেতৃবৃন্দের ইতিপূর্বেকার মতৈক্যকেই আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করবে এবং মতপার্থক্যকে কখনওই মতবিরোধে পরিণত হতে দেবে না।

এরপরও ভারতকে ক্রমাগত চাপ দিয়ে যেতে থাকে চীন। এ চাপের মুখে ভারত বাধ্য হয় নয়া দিল্লিতে চার দেশীয় বৈঠক বাতিল করতে আর চলতি সপ্তাহে টোকিও বৈঠকের পর একটি দায়সারা বিবৃতি দিতে।
টোকিও বৈঠকে কী হয়েছে তার পুরো বিবরণ এখনও সহজলভ্য নয়। এটাকে বলা যায় একটা ফর্মাল ইভেন্ট। তবে এতে লুকিয়ে আছে আগামী দিনের ''এশিয়ান ন্যাটো''র বীজ। এশিয়ায় শান্তির এবং আরেকটি মহাযুদ্ধের আশঙ্কা - দু'টোই লুকিয়ে আছে সেখানেই।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে