ইরান কি আরমেনিয়ার পক্ষে !

ইস্তানবুলে আজারবাইজান ও তুরস্কের পতাকা নিয়ে তুরস্কে বসবাসরত আজারিদের মিছিল - টিআরটি ওয়ার্ল্ড

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ০৭ অক্টোবর ২০২০, ১৪:১৯

রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কিছু নেই - এমন একটা কথা আমাদের দেশে বেশ প্রচলিত আছে। একশ্রেণীর সুবিধাবাদী রাজনীতিক ডিগবাজি দেয়ার পর অজুহাত হিসেবে প্রথমেই এ কথাটি বলে থাকে। আর আড়ালে-আবডালে রসিকজন বলে থাকেন, শুধু শেষ কথা কেন, রাজনীতিতে 'নীতি' বলতেও কিছু নেই।

নইলে এমন হবে কেন?
বলা প্রয়োজন যে, আর্মেনীয় অধ্যুষিত নাগোরনো-কারাবাখ নিয়ে আজ়ারবাইজান ও আর্মেনিয়ার বিবাদ দীর্ঘদিনের। ১৯৯৪ সালে অস্ত্রবিরতির আগে দু'দেশের যুদ্ধে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ওই লড়াইয়ের পর ওই অঞ্চলটি দখল করে নেয় আর্মেনীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। ২০১৬ সালে ওই এলাকায় সংঘর্ষে ১১০ জন নিহত হয়েছিলেন। এখন আবার সেখানে যুদ্ধের আগুন জ্বল্ব উঠেছে।

দু'দেশের মধ্যে হানাহানি লাগলে যা হয়, আরো কয়েক পক্ষ এসে জোটে এবং কেউ এর পক্ষে, কেউ ওর পক্ষে দাঁড়িয়ে যায়। এখানেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি, রাশিয়া দাঁড়িয়েছে আর্মেনিয়ার পক্ষে আর তুরস্ক নিয়েছে আজারবাইজানের পক্ষ।

কিন্তু এ কী করলো ইরান? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা সীমাহীন বিস্ময় নিয়ে দেখলেন, এ সংঘাতে ইরান তলে-তলে নিয়েছে আর্মেনিয়ার পক্ষ। এমন তো হওয়ার কথা নয়! আজারবাইজান ও ইরান - দুটিই শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ আর আর্মেনিয়া হলো খ্রিস্টান-অধ্যুষিত। এ অবস্থায় ইরানের তো আজারবাইজানের পক্ষই নেয়ার কথা। কিন্তু পর্যবেক্ষকদের সতর্ক চোখে ধরা পড়লো, ইরান গোপনে আর্মেনিয়াকেই মদদ দিচ্ছে। অবশ্য প্রকাশ্যে উভয় দেশকে সংঘাত বন্ধ করতে বলেছে ইরান এবং মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে।

তারপরও পর্যবেক্ষকদের সন্দেহ যায় না। তুরস্কের একজন পর্যবেক্ষক তাই বলেন, খালি চোখেই দেখা যায় আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া - এ দু' দেশের মধ্যে আর্মেনিয়ার সাথেই ইরানের সম্পর্ক বেশি ঘনিষ্ঠ। এর কারণও আছে। যেমন, রাশিয়ার সাথে রয়েছে ইরানের রাজনৈতিক মৈত্রী। এ সংঘাতে রাশিয়া নিয়েছে আর্মেনিয়ার পক্ষ। অতএব এখানে আর্মেনিয়ার বিপক্ষে যাওয়াটা অনেকটা রাশিয়ার বিপক্ষে যাওয়ার মতোই হয়ে যায়। ইরান এ ঝুঁকি নিতে চায় না। তাছাড়া আর্মেনিয়ার সাথে ইরানের রয়েছে ব্যাপক বাণিজ্যিক সম্পর্ক। সেটাও হারাতে চায় না তারা।
আরো কারণ আছে। ইরানের আজারী তুর্কী জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে তুর্কী জাতীয়তাবাদী প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে আর এ প্রবণতাকে একটা গুরুতর রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবেই দেখছে ইরান। তুরস্কের উত্তরাঞ্চলে বাস করে আজারী তুর্কী জাতিগোষ্ঠীর বিপুলসংখ্যক মানুষ। তাদের সাথে আজারবাইজানের যোগাযোগ ও সম্পর্ক ইরান-আজারবাইজান রাজনৈতিক সমস্যার একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর।

অনেকে মনে করেন, ইরানের আজারী তুর্কী জাতিগোষ্ঠীর সংখ্যা সে-দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ ছুঁয়ে যেতে পারে। আজারীদের অনেকেই ইরানের উত্তরাঞ্চলকে 'দক্ষিণ আজারবাইজান' নামেও ডেকে থাকে। কেননা, ওখানে প্রায় দুই কোটি আজারী বসবাস করে থাকে। আজারী জাতীয়তাবাদী ও বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই তাই বলে থাকেন, উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চল যেহেতু সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ে অভিন্ন, তাই তারা একটি রাজনৈতিক পরিচয়ে একীভূত হতে পারে বা হওয়া উচিত।

এক বিশেষজ্ঞের মতে, ইরানে যেহেতু বিপুলসংখ্যক তুর্কী জনগোষ্ঠীর বসবাস, তাই এমন একটা ভয় ঐতিহাসিকভাবেই চলে আসছে যে, উত্তর ও দক্ষিণ আজারবাইজান কোনো-না-কোনো পয়েন্টে এসে এক হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া বৃহত্তর আজারবাইজান গঠনের একটা রাজনৈতিক ভাবধারা ও পররাষ্ট্রনীতি আজারবাইজানের তো রয়েছেই। এ ক্ষেত্রে সেটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর।

গত কয়েক শতাব্দী ধরে ইরান ও আজারবাইজান শাসিত হয়েছে তুর্কী বংশোদ্ভূত দেশগুলোর দ্বারা - সেলজুক থেকে সাফাভিদ এমনকি কখনো কখনো কাজারদের দ্বারাও। ঊনবিংশ শতাব্দীতে, কাজারদের শাসনামলে, রাশিয়ার সাথে কয়েকটি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে শিয়া-তুর্কী বংশোদ্ভুতরা তাদের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল রাশিয়ার কাছে হারিয়ে ফেলে। আরাস বা আরাক্সেস নদী হয়ে যায় তাদের সীমান্তরেখা।

১৯১৭ সালে কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর আজারবাইজানের উত্তর অংশ হয়ে যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ। তাদের নাম হয় আজারবাইজান প্রজাতন্ত্র। আর দক্ষিণ অংশ থেকে যায় কাজারদের অধীনে। বিংশ শতাব্দীতে তারা চলে আসে ইরানের অধীনে।

কিন্তু এ অংশের কথা ভুলে যায় না আজারবাইজান। তাদের স্বপ্ন, উভয় অংশ মিলে একটি বৃহত্তর আজারবাইজান গঠনের। তাদের এ স্বপ্নকে একটা বড় হুমকি বলেই মনে করে ইরান। আর তাই আজারবাইজানকে চাপে রাখতে তারা পক্ষ নেয় আর্মেনিয়ার। একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, দক্ষিণ ককেসিয়াজুড়ে আজারবাইজান ও তুরস্কের বিপক্ষে ইরানের ঐতিহ্যবাহী আর্মেনিয়া পলিসি কাজে দিয়েছে ভারসাম্যের মতো। ঠিক এ কারণেই এখনও, পর্দার অন্তরালে হলেও, আর্মেনিয়াকে মদদ দিচ্ছে ইরান।

ইরান শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ আর আজারীরা শতভাগ শিয়া মতাবলম্বী হলেও কথা বলে কিন্তু তুর্কী উচ্চারণে, যা প্রায় তুরস্কের তুর্কীদের মতোই। কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর তারা তুরস্কের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে।
এদিকে বিশ্বায়নের ফলে ইরানে বসবাসকারী আজারী জনগোষ্ঠী যখন প্রতিবেশী দেশগুলোতে, বিশেষ করে আজারবাইজান ও তুরস্কে বসবাসরত তাদের জাতিগত ভাইদের সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়, তখন তাদের মাঝেও জাতীয় চেতনা ক্রমেই জোরদার হতে দেখা যায়।

আর আড়ালে-আবডালে রসিকজন বলে থাকেন, শুধু শেষ কথা কেন, রাজনীতিতে 'নীতি' বলতেও কিছু নেই। ছবি : টিআরটি ওয়ার্ল্ড
আর আড়ালে-আবডালে রসিকজন বলে থাকেন, শুধু শেষ কথা কেন, রাজনীতিতে 'নীতি' বলতেও কিছু নেই। ছবি : টিআরটি ওয়ার্ল্ড

 

আজারবাইজানে তুর্কী জাতীয়তাবাদের ক্রম-উত্থান ছাড়াও আর্মেনিয়াকে ইরানের সমর্থন দেয়ার পেছনে অন্য আরো রাজনৈতিক কারণও রয়েছে। যেমন, ইরান ও আজারবাইজানের ভূমি বিরোধ, আজারী তুর্কীদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান জাতীয়তাবাদী চেতনা, কাস্পিয়ান সাগরের প্রাকৃতিক সম্পন বণ্টন ইস্যু, ইসরাইলের সাথে আজারবাইজানের ঘনিষ্ঠতা এবং তুরস্ক-আজারবাইজান সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষার রাজনৈতিক ইচ্ছা ইত্যাদি নিয়ে ইরান-আজারবাইজান সম্পর্ক মাঝে-মাঝেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কেউ-কেউ মনে করেন, আর্মেনিয়া যদি ইরানের মদদ পেয়ে থাকে, তাহলে বর্তমান উত্তেজনা যুদ্ধেও রূপ নিতে পারে। দেখার বিষয় হলো, ইরান কী করে। তবে মনে হচ্ছে না যে ইরান এ সংঘাতে সামরিকভাবে জড়িয়ে পড়বে।

সর্বশেষ খবর হলো, রাশিয়া বুধবার দুই দেশকে আলোচনার টেবিলে আসার আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া - কোনো দেশই এই প্রস্তাবে কর্ণপাত করেনি। আজারবাইজানের তরফে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়া হয়েছে, আর্মেনিয়া নাগর্নো-কারাবাখ থেকে সরে গেলেই তারা শান্তি প্রক্রিয়ায় অংশ নেবে। তার আগে পর্যন্ত যুদ্ধ প্রক্রিয়া জারি থাকবে। আর্মেনিয়াকে শিক্ষা দেয়া হবে। অন্য দিকে আর্মেনিয়াও জানিয়েছে, আজারবাইজান তাদের এলাকা দখল করার চেষ্টা চালাচ্ছে। তাদের উচিত জবাব দেওয়া হবে।
এমন অবস্থায় এ মুহূর্তে আর বেশি কিছু বলার নেই। এখন কেবল দেখার পালা, কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে গড়ায়।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে