তুরস্ক থেকে কি ন্যাটোর সামরিক ঘাটি সরানো হচ্ছে

কার্টুনটি করেছেন লুইস ভ্যাজকুয়েজ - গলফ নিউজ

  • মেহেদী হাসান
  • ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৫:১৭

তুরস্ক থেকে ঐতিহাসিক ইনসারলাক সামরিক ঘাটি গ্রিসে সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করছে যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর গ্রিস এবং গ্রিক সাইপ্রিয়টের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান প্রকাশ্য এসেছে।

গ্রিস-তুরস্ক উত্তেজনার মধ্যে গ্রিক সাইপ্রিয়ট সফর করেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও। মধ্যপ্রাচ্য এবং ভূমধ্য সাগর অঞ্চলে তুরস্ক ও রাশিয়ার প্রভাব কমাতে নতুন এই পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে বলে ধারনা করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে সাইপ্রাস দ্বীপ হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার প্রক্সি যুদ্ধের নতুন ক্ষেত্র। বিডি ভিউজ ইনফোটেইনমেন্টে স্বাগত জানাচ্ছি সুরভি দিবা। তুরস্ক ও ন্যাটো জোটের সর্ম্পকের টানাপড়েন নিয়ে আজ আমরা আলোচনা করবো।

যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ক থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিমান ঘাটি গ্রিসে সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনার কথা প্রথম প্রকাশ করেন একজন রিপাবলিকান সিনেটর। তুরস্কের দক্ষিনে আদান প্রদেশে রয়েছে ন্যাটোর ইনসারলাক বিমান ঘাটি।

কৌশলগতভাবে ইনসরারলাক একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাটি। এ ঘাটিতে মজুদ রয়েছে ৯০টি পারমানবিক বোমা। ইনসারলাক ঘাটি ন্যটোরা আওতায় তুরস্ক এবং যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রন করছে।

এই ঘাটি সরিয়ে নেয়ার বিষয়ে সিনেটের ফরেন রিলেশনস সাব কমিটি ফর ইউরোপের চেয়ারম্যান রন জনসন বলেছেন, আমরা ইতোমধ্যে তুরস্ক থেকে ঘাটি সরিয়ে এনে গ্রিসে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছি। যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে গ্রিসের ক্রেট দ্বীপের সাউদা উপসাগরে সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করছে।

১১ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটন এক্সামিনারকে দেয়া সাক্ষাতকারে এ তথ্য ফাঁস করেন রন জনসন।
জনসন বলেন, আমরা জানি না ইনসারলাকে কী ঘটতে যাচ্ছে। সবচেয়ে ভাল কিছু আশা করতে পারি। কিন্তু আমাদের সবচেয়ে খারাপের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তবে তুরস্ক থেকে গ্রিসে ঘাটি সরিয়ে নেয়া বিষয়ে সিনেটর রন জনসনের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ডিফেন্স ডিপার্টমেন্ট। ১৫ সেপ্টম্বর পেন্টাগনের মুখপাত্র লে. কর্ণেল টমাস ক্যাম্পবেল বার্তা সংস্থা আনাদুলুকে বলেন, ইনসারলাক থেকে বিমান ঘাটি সরিয়ে নেয়ার যুক্তরাষ্ট্রের কোনো পরিকল্পনা নেই। ইনসারলাকে আমাদের উপস্থিতি তুরস্ক -যুক্তরাষ্ট্র শক্তিশালী সম্পর্কের প্রমান।

তুরস্কের ইনসারলাক সামরিক ঘাটির অবস্থান সিরিয়া সীমান্ত থেকে ৬৮ মাইল দূরে । ১৯৫৪ সালে এ ঘাটি স্থাপন করা হয়। স্থাপনের পর থেকেই কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এ ঘাটি। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘ ঠান্ডা লড়াই, ১৯৯০-৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধ এবং যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সিরিয়া ও ইরাকে আইএসআইএসসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এ ঘাটি।

যুক্তরাষ্ট্র এবং তুরস্ক এয়ারফোর্স ব্যবহার করে এ ঘাটি। এ ঘাটিতে যুক্তরাষ্ট্রের ৫ হাজারের বেশি বিমান সেনা রয়েছে। এ ছাড়া স্পেন আর্মিরও একটি ইউনিট রয়েছে এখানে। এ ঘাটিতে রয়েছে ৩ মাইলের অধিক দীর্ঘ রানওয়ে। রয়েছে বিমান রাখার ৫৭টি শেল্টার। আর এখানেই মজুদ রয়েছে ৯০টি পারমানবিক বোমা।

তুরস্ক ন্যাটো সদস্য। ন্যাটোর ৫টি দেশ রয়েছে যাদের নিজস্ব উৎপাদিত পারমানবিক বোমা নেই কিন্তু অন্যদের বোমা মজুদ রয়েছে। তুরস্ক এ ধরনের একটি দেশ। ন্যাটোর নিউক্লিয়ার শেয়ারিং পলিসি অনুযায়ী তুরস্কে এ বোমা মজুদ রয়েছে। এসব পারমানবিক বোমা যুক্তরাষ্ট্রের। তুরস্কে মজুদ থাকা ৯০টি পারমানবিক বোমার মধ্যে ৪০টি বোমা তুরস্ক সশস্ত্র বাহিনীর ব্যবহারের জন্য বরাদ্দ রয়েছে। যে কোনো দেশের সাথে পারমানবিক যুদ্ধ শুরু হলে তুরস্ক এসব বোমা ব্যবহার করতে পারবে। পারমানবিক বোমা মজুদ রয়েছে এ ধরনের অপর চারটি ন্যাটো সদস্য দেশ হলো জার্মানি, ইতালি, বেলজিয়াম এবং নেদারল্যান্ডস।

যুক্তরাষ্ট্র যদি এ ঘাটি সরিয়ে নেয় তা হবে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অবস্থানে বড় ধরনের পরিবর্তন। তুরস্কও ইতোমধ্যে ইনসারলাক সামরিক ঘাটি বন্ধের ইঙ্গিত দিয়েছে। এর আগে তুরস্কের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপের হুমকি দেয়ায় তুরস্কও হুমকি দিয়েছিল ইনসারলাক সামরিক ঘাটি এবং পূর্ব মালাতিয়া প্রদেশের কারেসিক রাডার স্টেশন বন্ধ করে দেয়ার। ১৯৭৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তুরস্ক তিন বছর বন্ধ করে দিয়েছিলো ইনসারলাক ঘাটি। এসময় ন্যাটোর জন্যও সীমাবদ্ধ রাখা হয় এ ঘাটির ব্যবহার।

গ্রিস-তুরস্ক চলমান উত্তেজনার মধ্যে গ্রিক সাইপ্রিয়ট সফর করেছেন যুক্তরাষ্ট্র পরররাষ্ট্র মন্ত্রী মাইক পম্পে। তার এ সফর এবং সেখানে গিয়ে তিনি যে বক্তব্য রেখেছেন তা ছিলো স্পষ্টভাবে গ্রিস এবং গ্রিক সাইপ্রিয়টের পক্ষে। ইতোমধ্যে গ্রিক সাইপ্রিয়টের ওপর থেকে দীর্ঘ অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। একই সাথে গ্রিক সাইপ্রিয়টে সামরিক প্রশিক্ষন কেন্দ্র স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছেন। এথেন্স থেকে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও গ্রিস যৌথ সামরিক মহড়া শুরু করতে যাচ্ছে।

মাইক পম্পেও ১৩ সেপেপ্টম্বর গ্রিক সাইপ্রিয়ট সফর করেন। এসময় পূর্ব ভ‚-মধ্য সাগরে তুরস্কের তেল গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি। পম্পেও বলেন, পূর্ব ভ‚-মধ্য সাগরের যেখানে গ্রিস এবং তুরস্কের আইনগত অধিকার রয়েছে সেখানে তুরস্কের চলমান তেল গ্যাস অনুসন্ধান পদক্ষেপের বিষয়ে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। রিপাবলিক অব সাইপ্রাসের অধিকার রয়েছে তার তেল গ্যাস উত্তোলনের। সাইপ্রাসের সমুদ্র এবং বিশেষ অর্থনৈতিক জোনে থাকা হাইড্রো কার্বন উত্তোলনেরও অধিকার রয়েছে।

মাইক পম্পেও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং সাইপ্রাস একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। সাইপ্রাসে একটি নতুন ট্রেনিং সেন্টার প্রতিষ্ঠার জন্য। এর পুরো অর্থায়ন করবে যুক্তরাষ্ট্র। সীমান্ত নিরাপত্তা, সমুদ্র এবং বন্দর নিরাপত্তা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তৈরি করা হবে এ সেন্টারের মাধ্যমে। পম্পেওর সাইপ্রাস সফর এবং সাইপ্রাসের ওপর থেকে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার সমালোচনা করেছে তুরস্ক।

এরমধ্যে এথেন্স থেকে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে পশ্চিম থ্রেসের কাছে যুক্তরাষ্ট্র এবং গ্রিস যৌথ সামরিক মহড়ার পরিকল্পনা করছে।

গত জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রী মাইক পম্পেও ঘোষণা করেন গ্রিক সাইপ্রিয়ট প্রশাসনকে ২০২০ সালে সামরিক প্রশিক্ষনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করবে। ভ‚-মধ্য সাগরে বিভিন্ন দ্বীপ ও সমুদ্র সীমা ছাড়াও সাইপ্রাস নিয়েও দীর্ঘদিন ধরে দ্ব›দ্ব চলছে তুরস্ক- গ্রীস এবং গ্রিক সাইপ্রিয়টের মধ্যে। সাইপ্রাসের উত্তর অংশ তুরস্ক নিয়ন্ত্রিত এবং দক্ষিন অংশ গ্রিক সাইপ্রিয়ট নামে পরিচিত।

বিশেষজ্ঞদের মতে ন্যাটো সদস্যদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ভারসাম্য রক্ষা নীতি পরিত্যাগ করে গ্রিস এবং গ্রিক সাইপ্রাসের পক্ষ নিয়েছে। যা তুরস্কের বিরুদ্ধে যায়। এতে এ অঞ্চলে সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে বরং উত্তেজনা বৃদ্ধি পাবে। তুরস্কের উত্থান রোধে গ্রিস এবং গ্রিক সাইপ্রিয়টের পক্ষ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র । যার লক্স্য তুরস্কের বিরুদ্ধে গ্রীস এবং গ্রিক সাইপ্রিয়টকে শক্তিশালী করা। গ্রীসের মিলিটারি শক্তিশালী করা এ কৌশলের একটি অংশ। একই সাথে তারা নিজেরাও এ অঞ্চলে তাদের সামরিক উপস্থিতি বাড়াতে পারে।

গ্রিক সাইপ্রিয়টে সামরিক উপস্থিতির মাধ্যমে লিবিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের ওপর প্রভাব বিস্তারের আরেকটি ফ্রন্ট পাবে যুক্তরাষ্ট্র। এখান থেকে সিরিয়া ইসরাইলের অবস্থানও বেশ কাছে। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র -গ্রিক সাইপ্রিয়টের মধ্যে একটি যৌথ মহড়া ১২ সেপ্টেম্বর শুরু হয়েছে এবং তা ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলার কথা রয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে তুরস্ক-গ্রিস দ্ব›দ্ব ঘিরে ভ‚-মধ্যসাগরে যে রাজনৈতিক মেরুকরন ঘটতে চলেছে তাতে ভারসাম্য আনতে হলে রাশিয়াকে ভ‚মিকা পালন করতে হবে। সাইপ্রাস দ্বীপ হতে পারে ভবিষ্যতে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রক্সিযুদ্ধের একটি কেন্দ্র।
যুক্তরাষ্ট্র এখন অনুধাবন করতে পেরেছে যে, সিরিয়া যুদ্ধে রাশিয়াকে টেনে এনে বড় ধরনের ভ‚ল করেছে। আর সিরিয়া যুদ্ধে এখন রাশিয়া মূল ভ‚মিকায় রয়েছে। সিরিয়া যুদ্ধ ঘিরে মধ্যপ্রাচ্য এবং ভূমধ্য সাগর অঞ্চলে শক্ত অবস্থান তৈরি হয়েছে রাশিয়ার। ভূমধ্য সাগরে বর্তমানে তৎপর রাশিয়ান বিভিন্ন শক্তিশালী রনতরী। তারা ব্যবহার করছে গ্রিক সাইপ্রিয়টের বিভিন্ন বন্দর। অপরদিকে তুরস্কের সাথে রাশিয়ার কৌশলগত সর্ম্পক ঘনিষ্ট হচ্ছে। সিরিয়ার ইদলিবে রাশিয়া ও তুরস্ক এক সাথে টহল কার্যক্রম চালাচ্ছে।

লিবিয়াতেও রাশিয়ার সাথে বোঝপড়ায় আসতে যাচ্ছে তুরস্ক। রাশিয়া থেকে ইতোমধ্যে এস-৪০০ ক্ষেপনাস্ত্র ব্যবস্থা নিয়েছে। যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তুরস্কের সর্ম্পকের টানাপড়েন তৈরি হয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র এখন আবার সরব হয়েছে। তুরস্কের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে ভুমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে উপস্থিতি আবার বাড়াতে চায়। সাইপ্রাসে সামরিক প্রশিক্ষন কেন্দ্র নির্মান ও সামরিক উপস্থিতি বাড়ানোর পরিকল্পনা তার প্রমান।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে