চীন ও ইরানকে নিয়ে আমেরিকার নিস্ফল ক্রোধ

বিশ্ব রাজনীতিতে কতো খেলাই না চলে - ইন্টারনেট

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৫:০৩

ইরানকে ঘৃণা করে আমেরিকা, আর চীনকে অপছন্দ করে ও ভয় পায়। তাই এ দু'দেশকে সম্ভাব্য সব উপায়ে চাপ দিয়ে চলেছে দেশটি। সে-ইতিহাসও সবার জানা। কিন্তু নানাভাবে চাপ দিয়েও কাঙ্খিত মাত্রায় সফল হতে পারছে না আমেরিকা। কোনো চাপেই না ইরানের অর্থনীতি একেবারে পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে, না পতন ঘটছে সে-দেশের ইসলামপন্থী শাসকদের।

এমন পরিস্থিতিতে নিস্ফল ক্রোধে প্রকাশ করা ছাড়া আর কীইবা করার থাকতে পারে বিশ্ব মোড়লের!

ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর অবস্থানের মাঝে আরেক খবর একেবারে হতভম্ব করে দিয়েছে মার্কিনীদের। খবরে বলা হয়, চীন ও ইরান ৪০ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের একটি বিনিয়োগ চুক্তি করতে যাচ্ছে।

খবর শুনে তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও। তিনি হুমকি দিলেন, ইরানের সাথে এরকম চুক্তি করলে চীনের ওপর অবরোধ আরোপ করবে আমেরিকা।

পম্পেও বলেন, ''যদি চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়, তাহলে আমাদের হাতে যত রকম উপায় আছে, নিশ্চিতভাবেই সব প্রয়োগ করবো। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ওপর যত রকম নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছি, তার সবই আরোপ করা হবে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি, তাদের ব্যবসাবাণিজ্য এবং সরকারী সকল প্রতিষ্ঠানের ওপর।''

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর হুমকি যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে চীন-মার্কিন অর্থনৈতিক সম্পর্ক পুরোপুরি শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তা কি হবে? কারণ, প্রস্তুত পণ্য চীনের যে জিডিপি আয়, তার চার ভাগের এক ভাগ আসে আমেরিকায় এসব পণ্য রফতানির আয় থেকে।

পম্পেও হুঁশিয়ার করে দেন, ''ইরানে চীনের 'প্রবেশ' মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থিতিশীল করে তুলবে। এ অস্থিতিশীলতা ইসরাইলকে ঝুঁকিতে ফেলে দেবে। ঝুঁকিতে ফেলবে সউদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমীরাতকেও। ইরান হচ্ছে বিশ্বে সন্ত্রাসবাদের সবচাইতে বড় মদদদাতা। তাদের হাতে অস্ত্র আছে। ব্যবসা-বাণিজ্য আছে। এখন তারা যদি চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কাছ থেকে অঢেল অর্থ পায়, তাহলে তা এ অঞ্চলের পরিস্থিতিকেই জটিল করে তুলবে মাত্র।''

চীন-ইরান ৪০ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের প্রস্তাবিত বিনিয়োগ চুক্তি প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আগেই মূল্যায়নধর্মী মন্তব্য করেন পররাষ্ট্র বিভাগের দুই সিনিয়র কর্মকর্তা কেইথ যে ক্রাচ ও ব্রায়ান এইচ হুক। তবে তাদের মূল্যায়ন ছিল অনেকটা সতর্ক।

ওয়াল স্ট্রীট জার্নালকে মার্কিন দুই কর্মকর্তা বলেন, ''বিনিয়োগের আকার ও সম্ভাব্যতা যথেষ্ট সংশয়ের দাবি রাখে। ইরানের অবকাঠামো খাতে ৪০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগের ক্ষমতা চীনের আছে কি না, তা নিয়েই আমাদের সন্দেহ আছে। কারণ, গত ১৫ বছরেই ইরানে তাদের বিনিয়োগ মাত্র দুই হাজার সাত শ' কোটি মার্কিন ডলার। সে-হিসাবে প্রস্তাবিত চুক্তিটিকে বড়জোর দু' দেশের সহযোগিতার একটা ফ্রেমওয়ার্ক বলতে পারি।''

প্রস্তাবিত চুক্তি প্রসঙ্গে গত জুলাই মাসে ''নিউ ইয়র্ক টাইমস' পত্রিকার এক খবরে বলা হয়, চুক্তিতে ফাইভ-জি মোবাইল ব্রডব্যান্ড অবকাঠামো নির্মাণ, চীনের গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেমে প্রবেশাধিকার এবং অস্ত্র নির্মাণের বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

এ ব্যাপারে বিস্তারিত আর কিছু জানা সম্ভব হয়নি। তবে একটা বিষয় পরিষ্কার যে, চুক্তিটি হওয়ার মানে হলো, চীন যা চেয়েছে তা-ই পেয়ে যাওয়া।

অথচ যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের তেল রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পর চীন-ইরান অর্থনৈতিক সম্পর্ক বেশ ঝাঁকুনি খায়। গত মে মাসে চীন দাবি করে যে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা মেনে নিয়ে ইরান থেকে তারা সবরকম আমদানি বন্ধ রেখেছে।

২০০৮ সালে ইরান তাদের মোট রফতানিকৃত তেলের ১৫ ভাগ পাঠাত চীনে। সেটা এখন এক শতাংশে নেমেছে।

কেউ-কেউ অভিযোগ করে, সরাসরি না-হলেও পরোক্ষভাবে ইরানের তেল কিনছে চীন। কখনো তারা 'মালয়েশিয়ার তেল' লেবেল লাগিয়ে ইরানী তেল কিনছে, কখনো বা মাঝ-সমুদ্রে ইরানী অয়েল ট্যাংকার থেকে চীনা ট্যাংকারে তেল ভরা হচ্ছে। এভাবে চীন তার মোট চাহিদার দুই ভাগ তেল পাচ্ছে ইরানের কাছ থেকে। ইরানের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য চীনের কাছে এই একটি সুযোগই যথেষ্ট, কিন্তু অর্থনৈতিক সঙ্কট কাটাতে ইরানের কাছে এটা যথেষ্ট নয়।

এখন প্রশ্ন হলো, মধ্যপ্রাচ্যে কী চায় চীন? ২০১৩ ও ২০১৬ সালে একজন বিশেষজ্ঞ মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার একটা ''চৈনিক সমাধানের'' সম্ভাব্যতার প্রশ্নটি উত্থাপন করেন। চীনের কোনো মধ্যপ্রাচ্য নীতি নেই, বৈশ্বিক নীতি বা গ্লোবাল পলিসি আছে।

আমেরিকা চাচ্ছে টেকনোলজিক্যাল সুপার পাওয়ার বা প্রযুক্তি পরাশক্তি হিসেবে চীনের উত্থানকে ঠেকিয়ে দিতে। চীন-ইরান প্রস্তাবিত চুক্তি গেøাবাল গেম বোর্ডে আমেরিকার বিরুদ্ধে চীনের একটি মোক্ষম চাল হতে পারে।

যেসব পলিসিমেকার আশায় আছেন যে, আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার পরিণামে ইরানে একসময় রেজিম চেঞ্জ বা শাসক বদল ঘটবে, সম্ভাব্য চীন-ইরান চুক্তি তাদের সামনে একটি মৌলিক কৌশলগত সত্যকেই তুলে ধরবে : চীন না-চাইলে কোনো মার্কিন চাপই ইরানী অর্থনীতিকে পঙ্গু করে ফেলতে পারবে না, শাসক বদল তো দূরের কথা।

চীন হচ্ছে ইরানের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। চীনের জিডিপি ইরানের ৩০ গুণ; ১৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। সে-হিসাবে ইরানের অর্থনীতিকে তুলনা করা যায় চীনের ছোট একটি প্রদেশের অর্থনীতির সাথে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাবেক এক উপদেষ্টা স¤প্রতি এক সাক্ষাতকারে জানান, মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগে এমন আলোচনাও শোনা যায় যে বিভিন্ন সমুদ্র ও ইউরেশিয়ান ভূখন্ডে নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা আঁটছে চীন।
তবে বাস্তবে চীন যদিও পর্যায়ক্রমে তার নৌবাহিনীকে গড়ে তুলছে, কিন্তু বৈশ্বিক ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য তারা কোনো অর্থ ব্যয় করেনি। তাদের স্পেশ্যাল ফোর্সগুলোর সদস্যসংখ্যা সাত হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১৪ হাজার, যেখানে আমেরিকার ক্ষেত্রে এ সংখ্যা ৬৬ হাজার। চীন তার নিজস্ব আওতার বাইরে সামরিক বিরোধে জড়িয়ে না-পড়ার নীতি গত পাঁচ শতাব্দী ধরে মেনে আসছে এবং তা পরিবর্তনের কোনোই কারণ নেই বলে মনে করেন অনেক পর্যবেক্ষক।

পারস্য উপসাগরে চীনের সামরিক উপস্থিতি নিয়ে যে-নতুন হুঁশিয়ারি দেয়া হচ্ছে, তা চীনের ব্যাপারে তাদের পূর্ববর্তী অভিযোগের একেবারে বিপরীত। তখন পশ্চিমা পর্যবেক্ষকরা বলতেন, পশ্চিমাদের সামরিক ব্যয়ের সুযোগ নিয়ে চীন একেবারে বিনা খরচে উপসাগরীয় এলাকা থেকে এশিয়ায় তেল নিয়ে যাচ্ছে।

চীন এখন তার জ্বালানি চাহিদা মেটানোর জন্য সমুদ্র ছেড়ে স্থলপথের দিকে মনোযোগ ফিরিয়েছে। তারা তেল ও গ্যাস আনার জন্য স্থলপথে বানিয়েছে পাইপলাইন, সড়কপথ ও রেললাইন। এগুলো মার্কিন বাহিনীর আওতার বাইরে তেল ও গ্যাস উৎপাদকদের যুক্ত করেছে।

এই ক্ষেত্রবদলটা চীনের জন্য প্রয়োজন ছিল, কিন্তু এটাই যথেষ্ট নয়। চীনের আগ্রহ কেন্দ্রীভূত রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রতি।

চীনকে তার মোট জ্বালানি চাহিদার ১৫ ভাগ আমদানি করতে হয়, যা আসে মূলত মধ্যপ্রাচ্য থেকে। এ অবস্থায় আগামী দিনগুলোতে মধ্যপ্রাচ্য যদি অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে, তা চীনের জ্বালানি সরবরাহের ক্ষত্রে ঝুঁকি তৈরি করবে। পাশাপাশি এটাও দেখার বিষয় যে, জ্বালানি আমদানির জন্য সমুদ্রপথের ওপর নির্ভরতা ধীরে ধীরে কমিয়ে আনছে চীন আর তাদের গ্যাসচালিত যানবাহনের জায়গা দখল করছে বিদ্যুৎচালিত যানবাহন। এ অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা নিয়ে ভবিষ্যতে তাদের আগ্রহ তেমন থাকবে না।

তখন ভূ-রাজনীতির দাবার গুটি আবার নতুন করে সাজানো হবে। চীন-পাকিস্তান, চীন-ইরান, চীন-রাশিয়া, চীন-ইসরাইল - অনেক সম্পর্কই তখন বদলে যাবে। আজকের শত্রু তখন হয়তো হবে পরম মিত্র, আজকের মিত্র যাবে হয়তো দূরে সরে।

রাজনীতিতে, বিশ্ব রাজনীতিতে কতো খেলাই না চলে! অতীতে চলেছে, এখনও চলছে, চলবে ভবিষ্যতেও।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে