যুক্তরাষ্ট্রকে পতনের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন ট্রাম্প-বাইডেন

ট্রাম্পের কাচে যেমন ভালো কিছু আশা করা যায় না। তেমনি বাইডেন এর কাছেও যুদ্ধ ছাড়া ভিন্ন কিছু আশা করা যায় না - এএফপি

  • মেহেদী হাসান
  • ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৫:৪২

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনকে সামরে রেখে বিভক্তি ও বিভাজন বাড়ছে। অনেক বিশ্লেষক বলছেন দুই প্রেসিডেন্ট প্রার্থী যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিপর্যয়কর হতে পারে। দেশটির নাগরিকদের জন্য দু:খজনক ঘটনা হলো, ট্রাম্প আর বাইডেনের চেয়ে ভালো কোনো প্রেসিডেন্ট বাছাই করার সুযোগ নেই।

অনেক বিশ্লেষক বলছেন ‘আমেরিকাস গট ট্যালেন্ট, জাস্ট নট পলিটিক্যাল ট্যালেন্ট’। খোদ এখন আমেরিকানরা এখন রাস্তায় স্লোগান দেয় ‘ডেথ টু আমেরিকা’। পৃথিবীতে সম্ভবত দ্বিতীয় এমন কোনো দেশ নেই যেখানে তাদের নাগরিকরা তাদের নিজ দেশের ধ্বংস কামনা করে রাজপথে স্লোগান দেয়। এটিই এখন দেশটির বাস্তবতা। গত সাত দশক ধরে বিশ্বব্যাপী শোষন, লুন্ঠন, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, হত্যাযজ্ঞ আর ধ্বংস লীলার মাধ্যমে গড়ে উঠা দেশটির নেতৃত্ব যুক্তরাষ্ট্রকে এ অবস্থানে নিয়ে এসেছেন।

সংসদের নিম্মকক্ষ হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ এর অধিবেশনে প্রেসিডেন্টের ভাষণ তারই সামনে ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেছেন স্পিকার। কারণ এ ভাষণ মিথ্যায় পূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসেও এ ঘটনা বিরল। ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সমালোচনা আর অভিযোগের শেষ নেই। কিন্তু ডেমোক্রেট প্রার্থী জো বাইডেনও নতুন কিছু তুলে ধরতে পারেননি। উল্টো আশঙ্কা করা হচ্ছে, বাইডেন প্রেসিডেন্ট হলে আমেরিকানদের যুদ্ধ, কঠোরতা এবং আরো বেশি হোয়াইট সুপ্রিমেসি বা বর্ণবাদ উপহার দেবেন।

প্রেসিডেন্ট বুশের ইরাক অভিযানের সময় জো বাইডেন ছিলেন ফরেন রিলেশন কমিটির চেয়ারম্যান। বুশ আর তার সহযোগী ব্লেয়ারের ইরাক অভিযানের পক্ষে যুক্তি ছিল, সাদ্দাম হোসেন ব্যাপক বিধ্বংসী মারানাস্ত্রের মজুদ গড়ে তুলেছে। এসময় জো বাইডেন এ অভিযানের পক্ষে তার এক লাইভ বক্তব্যে বলেন, সাদ্দাম হোসেন পারমানবিক বোমা বানাতে যাচ্ছে। সাদ্দামবিহীন পৃথিবী হবে একটি ভালো পৃথিবী।

জো বাইডেনও সাদ্দামের হাতে উইপন অব ম্যাস ডিসট্রাকশন, ক্যামিক্যাল ও বায়োলজিক্যাল উইপনস থাকার কথা বলেছিলেন। ইরাক যুদ্ধের পক্ষে তিনি তখন জোরালো বক্তব্য রাখেন। সাদ্দাম হোসেনকে আল কায়েদার সাথে সম্পৃক্ত করারও চেষ্টা করেন বাইডেন।

ইরাক যুদ্ধের ৯ মাস পরেও বাইডেন এই অভিযানের পক্ষে এবং এ অভিযানের জন্য বুশের প্রতি সমর্থন জানান। এই যুদ্ধকে সঠিক প্রমানের চেষ্টা করেন। বুশকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাহসী লিডার হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বাইডেন বলেন, আমি এবং অনেকেই তাকে সমর্থন করি। যুক্তরাষ্ট্রের এই ইরাক অভিযানের ফলে তছনছ হয়ে গেছে গোটা মধ্যপ্রাচ্য।

জো বাইডেনের মত প্রার্থীর কারনে অনেক ডেমোক্রেটরা হতাশ। তারা মনে করনে ট্রাম্পকে প্রার্থী করার মধ্যদিয়ে ট্রাম্পকে আরেক টার্ম ক্ষমতায় থাকার সুযোগ দেয়া হয়েছে। অনেকের অভিযোগ বাইডেনও একজন ইহুদীবাদী প্রার্থী। তিনিও ইহুদী ঘণিষ্ঠ। আর অনেক আমেরিকানের বর্তমান চাওয়া হলো ইহুদী সংযোগমুক্ত একজন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট। আবার অনেকের অভিযোগ ক্যারিয়ার পলিটিশিয়ান জো বাইডেন আমেরিকান দুর্ণীতগ্রস্ত অভিজাত সিস্টেমের ঘণিষ্ঠ বন্ধু।

কৃষ্ণাজ্ঞ সাংবাদিক গ্লেন ফোর্ড বাইডেনকে আখ্যায়িত করেছেন একজন কট্টর বর্ণবাদী এবং যুদ্ধবাজ হিসেবে। বাইডেনের কৃষ্ণাজ্ঞ রানিং মেটকেও করপোরেট ডেমোক্রেট মেশিনের বাছাই হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বাইডেনের রানিং মেট কমলা হ্যারিস তার ইলেকটোরাল ক্যারিয়ার শুরু করেছেন পুলিশ ইউনিয়নের এনডোর্সমেন্ট নিয়ে। অনেকের মতে ডেমোক্রেট প্রার্থী বার্ণি স্যান্ডারসকে বসিয়ে দেয়ার মাধ্যমে এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রতিযোগিতার অবসান হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে একটি উচ্চ সামরিকায়নকৃত অভিজাত রাষ্ট্র। দেশটিতে বেড়ে চলেছে ব্যাপক সামাজিক বৈষম্য। আর এ নিয়ে নেই কোনো তথ্যভিত্তিক পাবলিক ডিবেট। কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্ব যে এই পরিস্থিতি থেকে দেশকে বের করে আনতে পারবে তেমন কেউ নেই।

জো বাইডেন আর ডেমোক্রেটদের এখন একমাত্র সমস্যা হলো ট্রাম্পকে কিভাবে হোয়াইট হাউজ থেকে বের করা যায়। আর ট্রাম্প এবং রিপাবলিকানদের একমাত্র সমস্যা হলো উগ্র বাম আর সমাজন্ত্রী হিসাবে চিহিৃত করে বাইডেনকে হোয়াইট হাউজে ঢুকতে না দেয়া। রিপাবলিকান সমাবেশ থেকে ক্যারিয়ার পলিটিশিয়ান বাইডেন এবং ডেমোক্রেটদের সমাজতন্ত্রী হিসেবে আখ্যায়িত করা একটি ডাহা মিথ্যা এবং হাস্যকর প্রচারনা ছাড়া কিছু নয়।

বাস্তবতা হলো দুই দলই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ মাত্র। আর এ মুদ্রাটি হলো আমেরিকান পুঁজিবাদের অভিজাত সিস্টেম আর দানবীয় মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স এর ওপর তাদের নির্ভরতা । ডেমোক্রেট আর রিপাবলিকান উভয় দলই হলো আমেরিকান এ সিস্টেমের হাতিয়ার।

ট্রাম্প, বাইডেন আর তাদের অন্তরঙ্গ বন্ধুরা আমেরিকান দুর্নীতিগ্রস্ত অভিজাত সিস্টেমের তৈরি। ফলে তারা আমেরিকার আসল সমস্যার কথা না বলে একে অপরকে এখন উগ্র ‘ডানপন্থী’ আর ‘বামপন্থী’ হিসেবে আক্রমন করছে। অনেকের মতে আমেরিকার মূল সমস্যা হলো সিস্টেম। কিন্তু সেটা আড়াল করে ডেমোক্রেটরা ট্রাম্পকে সব সমস্যার জন্য দায়ী করছে। বাইডেনকে মনে করা হয় তিনি অভিজাত সিস্টেমের দীর্ঘ দিনের বন্ধু। তার বিরুদ্ধে রয়েছে বিদেশে অসংখ্য যুদ্ধ পরিকল্পনার রেকর্ড।

অনেকের আশঙ্কা যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক বিভক্তি আর সামাজিক বিশৃঙ্খলার দিকে ধাবিত হচ্ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ আমেরিকানরা পরষ্পরের মুখোমুখি অবস্থানে দাড়াচ্ছে। কারন রাজনীতিবিদরা তাদের মিথ্যা তথ্য দিয়ে ভুল পথে পরিচালিত করছে। নিজেদের মধ্যে বিভেদ আর সংঘাত সৃষ্টির চেষ্টা করছে।

ট্রাম্প সমাজতন্ত্র থেকে আমেরিকাকে বাচানোর আহবান জানাচ্ছেন। আর বাইডেন ট্রাম্পবাদ থেকে আমেরিকাকে বাচানোর আহবান জানাচ্ছেন। আমেরিকাকে সমাজতন্ত্র আর নৈরাজ্য থেকে বাঁচানো পবিত্র দায়িত্ব মনে করছে ট্রাম্প সমর্থকরা। পরিস্থিতি এমন যে সাধারন আমেরিকানরা একে অপরকে গুলি করে মারতে শুরু করলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
অনেক স্বাধীন বিশ্লেষক মনে করেন, আমেরিকায় এখন দরকার দুর্ণীতিগ্রস্ত অভিজাত সিস্টেমের বিরুদ্ধে সাধারণ আমেরিকানদের উদ্ভুদ্ধ করা। আমেরিকান করপোরেট পুঁজিবাদ এর রাজননৈতিক ব্যধি থেকে আমেরিকাকে বের করে আনা। এগুলো না করা পর্যন্ত ফ্যাসিবাদ আর গৃহযুদ্ধের ভয়াবহ সম্ভাবনা নিয়ে নিচের দিকে নামতে থাকবে আমেরিকা।

যুক্তরাষ্ট্রে চলমান বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে উঠে এসেছে সাবেক কৃষাজ্ঞ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার নাম। অনেকেই প্রকাশ্যে বলছেন ওবামা কালো হয়েও কালোদের জন্য কিছ‚ই করেননি। সুতরাং হোয়াইট হাউজে কে বসল সেটা কোনো বিষয় নয় । কারন সেখানে যারা বসেন তাদেরকে চিনতে হয় কে তাদের আসল বস। বসকে চিনতে না পারলে তাদের পক্ষে ক্ষমতায় থাকা তো দূরের কথা জীবন রক্ষাও অসম্ভব হয়ে পড়ে।

হোয়াইট হাউজে বসা কোনো এক ব্যক্তির কথায় আমেরিকা চলে না। আমেরিকা চলে সিস্টেমে। হোয়াইট হাউজ ছাড়াও আমেরিকান প্রশাসন এবং প্রশাসনের বাইরে অনেক বস এবং ক্ষমতা নিয়ন্ত্রনকারী আছে। বারাক ওবামার নির্বাচনী স্লোগান ছিল ‘চেঞ্জ উই নিড’। কিন্তু প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও তিনি গুয়ানতানামো কারাগার বন্ধ করে দেয়ার মত জোরালো একটা প্রতিশ্রুতিও বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

আসলে ওবামার হোয়াইট হাউজে বসার মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট পদে একজন ব্যক্তির পরিবর্তন হয়েছিল। আমেরিকার পরিবর্তন হয়নি। ওবামার প্রথমবার নির্বাচনী প্রচারণা গোটা যুক্তরাষ্ট্রে একটি গণজোয়ার সৃষ্টি করেছিল। মানুষের মনে সঞ্চার হয়েছিল পরিবর্তনের অতি আশা। ওবামার মধ্যে সাধারণ আমেরিকানরা তাদের নিজেদের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছিল।

ট্রাম্পের ইসরাইল ও ইহুদী সংযোগ প্রাকাশ্য। তার জামাতা, উপদেষ্টা জারেড কুশনার একজন ইহুদী। কিন্তু বাইডেন ক্ষমতায় আসলে তিনিও ইসরাইলের নীতি মেনে চলবেন না এমন কোনো গ্যারান্টি নেই। তার ক্ষমতায় আসায় মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে সে বিষয়ে কেউই আশ্বস্ত হতে পারছেন না।

আমেরিকার অভিজাত শ্রেণি এবং তাদের মিডিয়া, করপোরেট শ্রেণি ঝুকছে জো বাইডেনের প্রতি। করোনা ভাইরাসে আমেরিকানদের মৃত্যুর জন্য ট্রাম্পকে দায়ী করা হচ্ছে। অথচ দীর্ঘদিন ধরে পদ্ধতিগতভাবে স্বাস্থ্য খাতকে বেসরকারি হাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। পাবিলক হেলথ সিস্টেমকে সঙ্কুচিত করার পরিণতির ফলে স্বাস্থ্য খাতে যে দুরাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে সে কথা বলা হচ্ছে না।

করোনা ভাইরাসের জন্য ট্রাম্পের মত বাইডেনও চীনকে বলির পাঠা বানাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের অন্য সব উপায় যখন ব্যর্থ হয় তখন তারা চীন রাশিয়াকে দোষারোপ করে।

আবার বাইডেন যে অর্থনৈতিক পরিকল্পনার ঘোষণা দিয়েছেন তাতে কর্মসংস্থান ও মর্যাদার কথা বলা হয়েছে। বাইডেনকে তার সমর্থকরা আখ্যায়িত করেছেন দরিদ্রদের বিরুদ্ধে যোদ্ধা হিসেবে। বৃদ্ধ বয়সে সত্যিই তিনি তার অতীত অবস্থান পরিবর্তন করেছেন তা অনেকে বিশ্বাস করে না।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে