এরদোয়ানকে কোনঠাসা করতে পারছেন কি ম্যাক্রো? চীন-ভারত কি সীমিত যুদ্ধের দিকে যাচ্ছে

পূর্ব ভুমধ্যসাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধান নিয়ে তুরস্ক ও গ্রিসের মধ্যে বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে ফ্রান্স - ইন্টারনেট

  • আলফাজ আনাম
  • ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৪:৪১

সপ্তাহের দুটি আলোচিত ঘটনা নিয়ে আজ আমরা আলোচনা করবো। ভুমধ্যসাগরের গ্রিস-তুরস্ক ও ফ্রান্সের মুখোমুখি অবস্থান অন্যদিকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় চীন ও ভারতের সৈন্যদের মধ্যে যুদ্ধের শঙ্কা। কী হতে যাচ্ছে পশ্চিম ও পূর্ব এশিয়ায় দুই অঞ্চলে। আসুন চলে যাই মুল আলোচনায়।

পূর্ব ভুমধ্যসাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধান নিয়ে তুরস্ক ও গ্রিসের মধ্যে বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে ফ্রান্স। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাধ্যমে তুরস্কের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের চেষ্টা করে যাচ্ছে প্যারিস। শুধু তাই নয় তুরস্কের ভেতরে নানা ভাবে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করে যাচ্ছে। লিবিয়ায় বিদ্রোহী নেতা খলিফা হাফতারের সৈন্যদের অস্ত্র প্রশিক্ষন দেয়ার পাশাপাশি কুর্দি বিদ্রোহীদের প্রকাশ্য সমর্থন দিচ্ছে ফ্রান্স। একই সাথে আরব আমিরাতকে সাথে নিয়ে তুরস্কের প্রতিবেশি দেশগুলোতে প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে ফ্রান্স। যার লক্ষ্য হচ্ছে তুরস্ককে কোনঠাসা করে ফেলা।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যক্রো ইতোমধ্যে তুরস্কের প্রতিবেশি দেশ ইরাক সফর করেছেন। অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারনে ইমানুয়েল ম্যাক্রো আভ্যন্তরিন রাজনীতিতে বেশ দূর্বল হয়ে পড়ছেন। করোনা মহামারীর কারনে কর্মসংস্থানের অভাব ও ট্রেড ইউনিয়নগুলোর আন্দোলনে বেশ চাপের মুখে আছেন ম্যাক্রা।

গত জুনে স্থানীয় নির্বাচনে তার দল খারাপ ফলাফল করেছে। এমন অবস্থায় ম্যাক্রো বিদেশে তার প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন। তার মধ্যপন্থী দল বিদেশ নীতিতে জাতীয়তাবাদীদের চেয়েও উগ্রপন্থা অনুসরন করতে চাইছে। তুরস্কের সাথে বিরোধের পেছনে কাজ করছে এই কৌশল। এর সাথে যোগ হয়েছে এজন্য সাবেক ঔপনিবেশ লিবিয়াতে ফ্রান্সের কোনঠাসা হয়ে পড়া।

লিবিয়াতে বিদ্রোহী নেতা খলিফা হাফতারকে সমর্থন দিচ্ছে রাশিয়া, ফ্রান্স, আরব আমিরাত ও মিশর। অপরদিকে জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে তুরস্ক। লিবিয়ায় তুরস্ক ও রাশিয়া এক ধরনের সমঝোতায় আসতে যাচ্ছে। ফলে যুদ্ধবিরতি কার্যকরের প্রক্রিয়া চলছে। সিরিয়ার ইদলিবের মতো সেখানে একটি নিরাপদ অঞ্চল গঠন করা হতে পারে। যেখানে রাশিয়া ও তুরস্কের সামরিক উপস্থিতি থাকবে।

এমন অবস্থায় পূর্বভুমধ্যসাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধানে গ্রিসকে সমর্থন দিয়ে তুরস্কের মুখোমুখি দাড় করিয়েছে ফ্রান্স। সামরিক শক্তির দিক দিয়ে তুরস্ক ও গ্রিসের মধ্যে বিরাট ব্যবধান। যুদ্ধ উন্মাদনা ছড়িয়ে অর্থনৈতিক ভাবে অনেকটা দেউলিয়া গ্রিসের কাছে যুদ্ধ বিমানসহ বেশ কিছু সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করছে ফ্রান্স। অপরদিকে তুরস্কের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় দেশগুলোকে সংগঠিত করার চেষ্টা করছে প্যারিস। কিন্তু জার্মানী ও ইতালির মতো দেশগুলো পুরোপুরি ভাবে ফ্রান্সের সাথে একমত নয়। র্জামানী ও ইতালির সাথে রয়েছে তুরস্কের নিবিড় বানিজ্যিক সর্ম্পক। ফলে তুরস্কের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত নেয়ার সম্ভাবনা একেবারেই কম। গ্রিস ও ফ্রান্স তুরস্কের অনুসন্ধাকারী জাহাজ ফিরিয়ে নেয়ার দাবি জানালেও এখন পর্যন্ত তা মেনে নেয়নি তুরস্ক।

এছাড়া ইউরোপীয় দেশগুলোর ওপর চাপসৃষ্টির অংশ হিসাবে এজিয়ান সাগরে রাশিয়ার সামরিক মহড়ার ঘোষণা দেয় তুরস্ক। একই সাথে দ্বিতীয় পর্যায়ে এস-৪০০ ক্ষেপনাস্ত্র ব্যবস্থা ও রাশিয়ার এসইউ-৩৫ যুদ্ধ বিমান কেনার ইঙ্গিত দেয় আঙ্কারা। এমন অবস্থায় তৎপর হয়ে উঠে ন্যাটোর কর্মকর্তারা। তুরস্কের সাথে আলোচনায় বসতে গ্রিসের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে ন্যাটো। তুরস্ক এমন ইঙ্গিত দিয়েছে তার সমুদ্রসীমার নিরাপত্তা রক্ষায় যে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে। অর্থাৎ রাশিয়ার সাথে তুরস্কের সামরিক সর্ম্পকের দিকে ইঙ্গিত করা হয়। এর ফলে এ অঞ্চলে ন্যাটোর প্রভাব আরো হুমকির মুখে পড়বে।

অন্যদিকে তুরস্কের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য কুর্দি বিদ্রোহীদের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে ফ্রান্স। যাতে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন। কিন্তু তা নিয়ে দেখা দিয়েছে নতুন জটিলতা। সিরিয়ায় কুর্দি এলাকায় তুরস্ক ও রাশিয়া একসাথে টহল কার্যক্রম চালাচ্ছে। রাশিয়ার সৈন্যদের ওপর কুর্দি বিদ্রোহীরা একাধিক হামলা চালিয়েছে। এই হামলায় রাশিয়ার একজন মেজর জেনারেল পর্যায়ের কর্মকর্তা নিহত হয়েছে। এরপর থেকে কুর্দি বিরোধী অভিযানে রাশিয়া ও ইরানের সমর্থন পাচ্ছে তুরস্ক। এমন পরিস্থিতিতে ম্যাক্রো ইরাক সফর করেছেন। কুর্দি বিদ্রোহীদের ওপর বিমান হামলায় ইরাকে পারমানবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মানের ঘোষণা দেন। ইরাকের ভেতরে কুর্দি বিদ্রোহীদের ওপর বিমান হামলা চালায় তুরস্ক। ইরাকের সাবভৌমত্ব রক্ষায় ইরাকের পাশে থাকার ঘোষনা দেন ম্যাক্রো। তিনি ইরাকের কুর্দি নেতাদের সাথেও বৈঠক করেন। ম্যক্রোর ইরাক সফর পরপরই কুর্দিস্থান রিজিওনাল গর্ভনমেন্টের প্রধান ইস্তাম্বুল সফর করেন এবং প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের সাথে বৈঠক করেন। যা ইরাকের কুর্দি নেতাদের ওপর তুরস্কের প্রভাবের ইঙ্গিত বহন করে। সব মিলিয়ে তুরস্কের বিরুদ্ধে অবস্থান ম্যক্রোর সফল হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই কম।

লাদাখ সীমান্তে ভারত ও চীনের সৈন্যরা মুখোমুখি অবস্থান করছে। কূটনৈতিক ও সামরিক পর্যায়ে আলোচনা চললেও উত্তেজনা কমছে না। বরং পরিস্থিতি নতুন মোড় নিয়েছে। উভয় দেশের পক্ষ থেকে টহলরত সৈন্যদের ওপর গুলি চালানোর অভিযোগ করা হয়েছে। চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী স্পষ্ট করে ভারতকে দায়ী করেছেন। চীনের গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে সীমান্তে সৈন্য সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র গ্লোবাল টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় মোদি সরকার ব্যর্থতা ও ভারতের অর্থনীতিতে যে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে তা আড়াল করতে সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি করা হয়েছে। এছাড়া জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও অষ্ট্রেলিয়ার সাথে চীন বিরোধী যে জোট গঠন করা হয়েছে তাতে ভারত গুরুত্ব বাড়াতে সীমান্তে বেপরোয়া আচরন করছে।

গ্লোবাল টাইমস বলছে, সীমান্তে যে কোনো সংঘাতে ভারতের জয়ের কোনো সম্ভাবনা নেই। বরং এতে ভারতের অর্থনীতি ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। এ ধরনের সংঘাতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ভারত থেকে চলে যাবে। এতে মোদির মেইক ইনডিয়া পলিসির স্বপ্ন ধুলিস্যাত হয়ে যাবে। অপরদিকে ভারতের গনমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে চীন সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ বাড়াচ্ছে। সীমিত আকারে সংঘাতের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আরো একাধিক ফ্রন্টে উত্তেজনা সৃষ্টি করছে। ইতোমধ্যে অরুনাচল তিব্বতের অংশ বলে দাবি করছে।

ভারতের গনমাধ্যমে বলা হচ্ছে সীমান্তে এখন যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে যে কোনো সময় যে কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। ভারতের সৈন্যদের সেভাবে প্রস্তুত করা হচ্ছে। ভারতের দাবি ২৯ আগস্ট লাদাখে কৌশলগত গুরুত্বপূর্ন কিছু এলাকা দখল করতে সক্ষম হয়েছে। এরপর থেকে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি সীমান্ত অতিক্রম করার চেষ্টা করছে। ভারতের সৈন্যরা তা প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছে। আর্ন্তজাতিক বিভিন্ন গনমাধ্যমের খবরে বলা হয় এ সময় ভারতের বিশেষ স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার্স ফোর্সের একজন সদস্য মারা যায়। এর আগে গত জুনে মারা যায় ভারতের ২৩ জন সৈন্য। ভারত সৈন্য সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি আগেই লাদাখে ট্যাংক, হেলিকপ্টার ও সাজোয়া যান মোতায়েন করেছে। যুদ্ধ বিমান ও হেলিকপ্টারের টহল কার্যক্রম চলছে। ভারতের সেনা প্রধান ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী লাদাখ সফর করেছেন।

গ্লোবাল টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতীয় সেনাবাহিনীর আগ্রাসী মনোভাবের কারনে চীন সার্বভৌমত্ব রক্ষায় লাদাখে সামরিক তৎপরতা বাড়িয়েছে। এতে বলা হয়েছে অতীতের মতো চীনের সৈন্যদের সামর্থ্য সর্ম্পকে ভুল ধারনা পোষন করছে। চীনের পিপলস আর্মি ভারতকে আগের মতো পরাজিত করতে সক্ষম।

চীনের সামরিক প্রস্তুতি নিয়ে ভারতের গনমাধ্যমে নানা ধরনের খবর প্রকাশ হচ্ছে। এতে বলা হয়েছে, সীমান্তে চীনের সৈন্য সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি বাড়নো হয়েছে এয়ার ডিফেন্স ব্যবস্থা, কামান, প্যারাট্রুপ্যার ও ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন। বসানো হয়েছে এইচজে-১০ অ্যান্টি ট্যাঙ্ক মিসাইল সিস্টেম। লাদাখের কঠিন পরিবেশে যুদ্ধে রপ্ত হওয়ার জন্য একাধিক বার মহড়া দিয়েছে চীনের বিমান বাহিনী। একাধিক এইচ-৬ বম্বার ও ওয়াই-২০ মালবাহী বিমানকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লাদাখে আনা হয়েছে। ভারতের সেনাসূত্রের বরাত দিয়ে বলা হচ্ছে , লাদাখে অন্তত এই মুহূর্তে চিনের ৫০ হাজার সেনা রয়েছে। যুদ্ধবিমান রয়েছে ১৫০টি। ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ঠেকাতে ভূমি থেকে আকাশ ব্যালিস্টিক মিসাইল বসিয়েছে চীন।

কিন্তু চীনের গনমাধ্যমে সীমান্তে কী ধরনের সৈন্য সমাবেশ করা হয়েছে সে সর্ম্পকে কোনো ধারনা পাওয়া যায় না। তবে চীনের কর্মকতারা যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন তাতে ধারনা করা হচ্ছে চীনের পক্ষ থেকে বড় ধরনের সামরিক প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের দাবি করা প্রায় ১ হাজার কিলোমিটার এলাকা ইতোমধ্যে চীনের নিয়ন্ত্রনে চলে গেছে।

লাদাখে উত্তেজনার মধ্যে ভারত অভিযোগ করছে অরুনাচল প্রদেশের একটি গ্রাম থেকে চীনের সৈন্যরা ৫ জন তরুনকে ধরে নিয়ে যায়। এ নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ের মুখপাত্র বলেন. এ ধরনের কোনো তথ্য তার কাছে নেই। এছাড়া অরুনাচল প্রদেশ বলে কোনো অঞ্চলকে চীন স্বীকৃতি দেয় না। এটি দক্ষিণ তিব্বতের অংশ। এরমধ্য দিয়ে স্পষ্ট ভাবে চীন বার্তা দিয়েছে সীমান্ত সংঘাত শুরু হলে শুধু লাদাখে নয় অন্য সীমান্তগুলোতেও তার প্রভাব পড়বে।

অনেক নিরাপত্তা বিশ্লেষক মনে করেন, আভ্যন্তরিন রাজনীতির কারনে ভারত ও চীনে যে জাতীয়তাবাদী উন্মাদনা তৈরি হয়েছে সীমান্তে তার প্রভাব পড়ছে। আগামি শীতে কারগিল যুদ্ধের মতো লাদাখেও বড় আকারের সংঘাতের ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। সম্ভবত দুদেশ সীমিত আকারে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে। কিন্তু এর প্রভাব হবে মারাত্মক ও সুদূরপ্রসারী।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে