যে দ্বীপ নিয়ে তুরস্ক ও গ্রিসের যুদ্ধপ্রস্তুতি

পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় তুরস্কের উপকূলের খুব কাছেই গ্রীসের কিছু দ্বীপ রয়েছে। মেইজ আইল্যান্ড বা কাস্তেলোরিজো এরই একটি - ইন্টারনেট

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৫:০১

তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় কাস জেলা থেকে দুই কিলোমিটার এবং গ্রিসের মূল ভূখন্ড থেকে ৫৮০ কিলোমিটার দূরে ১০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ছোট্ট একটি দ্বীপ। তুরস্ক একে ডাকে মেইজ আইল্যান্ড বলে, আর গিসের কাছে এটি কাস্তেলোরিজো। ছোট্ট এ দ্বীপটি তুরস্ক ও গ্রিসের মধ্যে সাম্প্রতিক বিরোধের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। বলা হচ্ছে, তুরস্ক ও গ্রিসের মাঝে পরবর্তী ক্রাইসিস স্পট হতে যাচ্ছে এই মেইজ আইল্যান্ড বা কাস্তেলোরিজো।

তুরস্কের কাস জেলার সাথে এ দ্বীপের রয়েছে গভীর বন্ধুত্ব ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক। এ কারণে দ্বীপটিকে কাস জেলার ''সিস্টার সিটি''ও বলা হয়ে থাকে। দ্বীপের বেশিরভাগ বাসিন্দা তুর্কি ভাষায় কথা বলে। বাজারসদাই করার জন্য, এমনকি সাপ্তাহিক ছুটি কাটাতেও দ্বীপবাসী যখন খুশি চলে আসে তুরস্কের কাস জেলায়। প্রতিদিন চলে এই আসা-যাওয়া।

কারণ, আসা-যাওয়ায় সময় লাগে মাত্র ২০ মিনিট। দুই উপকূলের বাসিন্দারা একসাথে আয়োজন করে নানা রকম উৎসব, প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের।

তুরস্ক ও গ্রিসের মধ্যে এমনিতেই আঞ্চলিক জলসীমা, মহীসোপান এবং সমুদ্রসীমা নিয়ে আরো নানা বিরোধ রয়েছে। এসব বিরোধ মীমাংসায় কোনো কূটনৈতিক উদ্যোগ না-থাকায় তা ক্রমেই সামরিক রূপ নিতে যাচ্ছে। পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় গ্যাস অনুসন্ধান দু'দেশের বিরোধের সুপ্ত আগুন উস্কে দিয়েছে।

পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় তুরস্কের উপকূলের খুব কাছেই গ্রীসের কিছু দ্বীপ রয়েছে। মেইজ আইল্যান্ড বা কাস্তেলোরিজো এরই একটি। তুরস্কের বারংবার হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও এ দ্বীপটিকে সামরিকীকরণ করে চলেছে গ্রিস। তুরস্ক মনে করে, এটা গ্রীসের নতুন ধরনের জলদস্যুতা। কেননা, ১৯৪৭ সালের প্যারিস শান্তি চুক্তি অনুযায়ী ওই দ্বীপটিকে সামরিকীকরণ নিষিদ্ধ।

প্যারিস চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে গ্রিস ওই দ্বীপটিকে সামরিক কাজে ব্যবহার করায় প্রচন্ড ক্ষুব্ধ তুরস্ক। তুর্কী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে কড়া ভাষায় বলা হয়, দ্বীপের চরিত্র বদলে দেয়ার এ অবৈধ উদ্যোগ আমরা প্রত্যাখ্যান করছি। আমরা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিতে চাই যে নিজ উপকূলের একদম কাছাকাছি এলাকায় এ ধরনের উস্কানিমূলক তৎপরতা তুরস্ক কিছুতেই মেনে নেবে না। বিবৃতিতে আরো বলা হয়, এ ধরনের উস্কানিমূলক তৎপরতা চালিয়ে গ্রীসের লাভ কিছুই হবে না। বরং এতে তাদেরই ভুগতে হবে বেশি।

দ্বীপটির চারপাশের এলাকায় ভূতাত্ত্বিক জরিপ চালাচ্ছে তুরস্ক, আর তাতেই যত আপত্তি গ্রিসের। তারা দাবি করে, সমুদ্রের ৪০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা তাদের। অতএব ওই দ্বীপও তাদের। তুরস্ক ওখানে জরিপ চালাবে কেন?

গত পয়লা সেপ্টেম্বর আংকারায় এক সংবাদ সম্মেলনে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাফ জানিয়ে দেন যে, গ্রীসের সম্প্রপ্রসারণবাদী দাবি আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। গ্রিসের দাবি মেনে নেয়া হলে এজিয়ান ও পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় তুরস্ককে একেবারে কোণঠাসা করে ফেলা হবে। তাই তাদের এ দাবি আমরা মানতে পারি না। তারা এ সমস্যার সমাধান না-খুঁজে উল্টা আমাদের উস্কানি দিয়ে চলেছে। এ উস্কানির ফল হবে বিপজ্জনক এবং এতে শেষ পর্যন্ত গ্রীসই ক্ষতিগ্রস্থ হবে।

আসল কথা হলো, দ্বীপটি আয়ত্তে রাখতে পারলে তুরস্ককে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় ঢুকতে বাধা দেয়া যায়। তাই গ্রিসের এতো চেঁচামেচি। তুরস্ক সরকার জবাবে বার বার বলে এসেছে যে, পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় একের পর এক দখলদারী মনোভাব দেখিয়ে এসেছে গ্রিস। কিন্তু তাতে জরিপকাজ কখনোই বন্ধ হয়ে যাবে না।

কাস্তোল­রিজো বা মেইজ আইল্যান্ডে গ্রিস সামরিক স্থাপনা নির্মাণ করছে বলে অভিযোগ করে তুরস্কের মন্ত্রী বলেন, ১৯৪৭ সালের প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী এ দ্বীপে সব রকম সামরিক তৎপরতা নিষিদ্ধ।

এ অবস্থায় দু'দেশের মধ্যে দ্বীপটি নিয়ে তুরস্ক ও গ্রিসের বিরোধ নিরসনে একবার এগিয়ে আসেন জার্মান কূটনীতিকরা। তাদের মধ্যস্থতায় উত্তেজনা প্রশমিত হয়। কিন্তু অল্পকালের মধ্যেই ফের জ্বলে ওঠে আগুন। সমুদ্রসীমা চিহ্নিতকরণ নিয়ে মিশরের সাথে গ্রীস একটি চুক্তি করা থেকেই সূত্রপাত নতুন বিরোধের। তুরস্কের মতে, এ চুক্তিতে তাদের মহীসোপান ও নৌসীমা অধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে।

ইতোমধ্যে এই দ্বীপে গ্রিস সৈন্য মোতায়েন করেছে বলে দাবি করেছে তুরস্ক। সৈন্যদের চলাচলের কিছু ছবি প্রকাশ করেছে তুরস্কের গনমাধ্যম। গ্রিসের পক্ষে জোরালো সমর্থন দিচ্ছে ফ্রান্স, আরব আমিরাত ও মিশর। ইউরোপীয় ইউনিয়নও গ্রিসের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে তুরস্কের ওপর অবরোধ আরোপের হুমকি দেয়া হয়েছে। গ্রিস আশা করেছিলো ইউরোপীয় ইউনিয়নের হুমকির পর তুরস্ক অনুসন্ধান কাজ বন্ধ করবে। বাস্তবে তা হয়নি। বরং তুরস্ক অনুসন্ধান কাজের মেয়াদ আরো বাড়িয়েছে।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, তুরস্ক তার অবস্থান থেকে সরে আসবে না। কারন গ্রিসের দাবি মেনে নিলে তুরস্ক ভুমধ্যসাগরে প্রবেশের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। এছাড়া সমুদ্রসীমা নিয়ে তুরস্ক ও লিবিয়ার মধ্যে যে চুক্তি হয়েছে তাও অনেকটা কার্যকারিতা হারাবে। এমন পরিস্থিতিতে ভুমধ্যসাগরে সংঘাত অনেকটা অনিবার্য হয়ে পড়ছে। এ ক্ষেত্রে আগ্রাসী ভূমিকা নিয়েছে ফ্রান্স। দেশটির বিমানবাহী রনতরী শ্যার্ল দ্য গলকে ভুমধ্যসাগরে যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়ে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া আরব আমিরাতের এফ-১৬ যুদ্ধ বিমান গ্রিসের বিমান ঘাটিতে অবস্থান করছে। গ্রিসের সামরিক মহড়ায় এসব যুদ্ধ বিমান অংশ নিয়েছে। ফ্রান্সের অতি আগ্রহের পেছনে রয়েছে অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা। ফ্রান্স ও ইতালির কয়েকটি কোম্পানিকে ভুমধ্যসাগরে গ্রিসের দাবি করা এলাকায় তেলগ্যাস অনুসন্ধানের অনুমতি দিয়েছে অ্যাথেন্স।

মেইজ দ্বীপে গ্রিক সেনা : টিআরটি ওয়ার্ল্ড
মেইজ দ্বীপে গ্রিক সেনা : টিআরটি ওয়ার্ল্ড

 

লিবিয়াতেও তুরস্কের সাথে ফ্রান্সের রয়েছে বিরোধ। তুরস্ক লিবিয়ায় জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে ফ্রান্স যুদ্ধবাজ নেতা খলিফা হাফতারের পেছনে এসে দাড়িয়েছে। এক সময় ফ্রান্সের ঔপনিবেশ এসব দেশে অন্য কোনো দেশের উপস্থিতি মেনে নিতে রাজি নয় ফ্রান্স। এক্ষেত্রে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যক্রোর ঔপনিবেশিক শাসকদের মতো আচরন করছেন। লিবিয়ায় গাদ্দাফি হত্যার পেছনে ছিলো ফ্রান্সের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর হাত। এখন ফ্রান্স ও আমিরাত এক হয়ে এঅঞ্চলে নানা ভাবে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। তুরস্কের কুর্দি গেরিলাদেরও দুদেশ সমর্থন দিচ্ছে।

তুরস্ক বলছে, গ্রিস সবসময় পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় সম্প্রসারণবাদী আচরণ করে এসেছে। দেশটি সমুদ্রের যতটা এলাকা নিজের বলে দাবি করছে তাতে তুরস্কের সার্বভৌম অধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়। এভাবেই চলছে দুই প্রতিবেশীর বিরোধ। এ আগুন আদৌ নিভবে, নাকি আরো পূর্ণ তেজে জ্বলে উঠবে, সে-কথা হলফ করে বলা যায় না।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে