চীন ইস্যুতে পিছু হটেছে অস্ট্রেলিয়া

অস্ট্রেলিয়া ঘোষণা দিয়েছে চীনের সাথে অস্ট্রেলিয়ার সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর এ সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত করার কোনো ইচ্ছা নেই অষ্ট্রেলিয়ার - ড্যাভিড রো, ফিন্যান্সিয়াল রিভিউ

  • মেহেদী হাসান
  • ১৩ আগস্ট ২০২০, ২০:০৩

চীন ইস্যুতে পিছু হটেছে অস্ট্রেলিয়া । অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন জুলাইয়ের শুরুতে প্রকাশ্যে চীনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মাঠে নামার ঘোষণা দেন। চীনের কারণে অস্ট্রেলিয়া অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখোমুখি বলে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। চীনকে মোকাবেলায় সকল উপায় অবলম্বনের ঘোষণা দেন মরিসন। এ ঘোষণার এক মাস না যেতেই অস্ট্রেলিয়া চীনবিরোধী লড়াই থেকে নিজেকে প্রত্যাহর করে নিয়েছে।

অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রী মেরিজ পেইন যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে ঘোষণা দিয়েছেন চীনের সাথে অস্ট্রেলিয়ার সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর এ সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত করার কোনো ইচ্ছা নেই অষ্ট্রেলিয়ার।

চীন বিষয়ে অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২৮ জুলাই। বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রী মাইক পম্পেও, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মার্ক এসপার, অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রী মেরিস পেইন, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী লিন্ডা রেনল্ডস অংশ নেন। বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হন দুই দেশের চার গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী। এসময় অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী চীনের সাথে সম্পর্ক রক্ষার ঘোষণা দেন। অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসময় বলেন, চীনের সবকিছুতে যেমন অস্ট্রেলিয়া একমত নয় তেমনি যুক্তরাষ্ট্রেরও সব কিছুতে অস্ট্রেলিয়া একমত নয়।

যুক্তরাষ্ট্র এবং অস্ট্রেলিয়া আইনের শাসনের প্রতিপ্রতিশ্রুতিবদ্ধ । চীনের সাথে আমাদের যে সম্পর্ক রয়েছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের এমন কিছু করার ইচ্ছা নেই যা আমাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাবে। তিনি বলেন, এশিয়া-প্যাসেফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র এবং অস্ট্রেলিয়ার অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে যা মুক্ত, সমৃদ্ধ এবং সুরক্ষিত। আর এর অনেক কিছুই চীনের সাথে ব্যাপকভাবে জড়িত।

যুক্তরাষ্টের সাথে সম্পর্ক বিষয়ে পেইন বলেন, আমরা সব বিষয়ে যদিও আমরা একমত নই। আর এটা সম্মানজনক সম্পর্কের অংশ। ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে স্থায়ী বন্ধুত্বের অংশ এটি।

যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কোন কোন বিষয়ে দ্বিমত সে বিষয়ে পরিষ্কার করে কিছু বলেননি অস্ট্রেলিয়ান পররাষ্ট্র মন্ত্রী পেইন। তবে তিনি বলেন, জাতীয় স্বার্থ এবং নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়া তার নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই গ্রহণ করে। চীনের সাথেও আমরা একইভাবে ডিল করে থাকি। চীনের সাথে আমাদের শক্তিশালী অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য সম্পর্ক রয়েছে। আর এটা চলমান রয়েছে দুই দেশেরই স্বার্থে।

যৌথ সংবাদ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রী মাইক পম্পেও বলেন, দক্ষিণ চীন সাগরে চীনা এক তরফা দাবির বিরুদ্ধে সব পক্ষের ন্যায্য অধিকার রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র এবং অস্ট্রেলিয়া এক সাথে কাজ করবে। যুক্তরাষ্ট্র জানে আপনারা এবং বাকী বিশ্ব যেসব হুমকি মোকাবেলা করছে। এবং যুক্তরাষ্ট্র আপনাদের পাশে আছে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের অংশ হিসেবে।

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো চীনের কঠোর সমালোচক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও। অস্ট্রেলিয়ার সাথে বৈঠকের আগে চীনের ওপর অধিকতর চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে মাইক পম্পেও যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোর মধ্যে নতুন ঐক্যের আহবান জানান । তিনি বলেন, এটা আমাদের সময়ের মিশন। সমমনা দেশগুলোকে নতুন করে জোটবদ্ধ হতে হবে বিশেষ করে গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মধ্যে।

এ ছাড়া মাইক পম্পে ২২ জুলাই ভারতের সাথে ভিডিও কনফারেন্সে চীনবিরোধী ‘কোয়াদ’ এর প্রতি সম্মতি দেন। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়া মিলে একটি অনানুষ্ঠানিক কৌশলগত ফোরাম হচ্ছে কোয়াদ। এর লক্ষ্য ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে চীনের উত্থান প্রতিরোধ করা এবং নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

চীন বিরোধী যুক্তরাষ্ট্রের এসব তৎপরতার মধ্যে হঠাৎ করে প্রকাশ্যে এভাবে অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রীর বক্তব্যে বিপাকে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্লেষকদের মতে ভেস্তে যাবার উপক্রম হয়েছে কোয়াদ গঠনের উদ্যোগ।

ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে চীন বিরোধী লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান মিত্র অস্ট্রেলিয়া। ভারতও চীন বিরোধী লড়াইয়ে সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে। অস্ট্রেলিয়াও বরাবর চীনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কথা বলে আসছে। উত্তর অস্ট্রেলিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ভারী বোমারু বিমান অবতরনের লক্ষ্যে বিমানবন্দর সংস্কারসহ নানা ধরনের সামরিক সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য।

অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন চীন বিরোধী লড়াইয়ে প্রকাশ্যে মাঠে নামার ঘোষণা দিয়েছিলেন। ভবিষ্যতে এ অঞ্চলে চীনের উত্থান আর আধিপত্য মোকাবেলায় ব্যাপক সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করে অস্ট্রেলিয়া।

কেবলমাত্র চীনকে মোকাবেলায় অস্ট্রেলিয়া ১৮৭ বিলিয়ন ইউএস ডলার বাজেট বরাদ্দ করেছে। ১ জুলাই অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন এ বাজেট বরাদ্দের ঘোষণা দেন। এ উপলক্ষে ক্যানবেরা ডিফেন্স ফোর্স একাডেমিতে সেনা সমাবেশে স্কট মরিসন বলেন, ভবিষ্যতে বিশ্ব আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের কেন্দ্রস্থল হলো ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চল। এ অঞ্চল ঘিরে চীন-যুক্তরাষ্ট্র-ভারত লড়াইয়ে অংশ নেবে অস্ট্রেলিয়া। চীনের উত্থান মোকাবেলায় সম্ভাব্য সকল পদপেক্ষ গ্রহণ করবে অস্ট্রেলিয়া। কারন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী মরিসন মনে করেন চীনের কারনে ভয়াবহ অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়েছে অস্ট্রেলিয়া।

চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতা মারাত্মক পর্যায়ে পৌছেছে। কিন্তু তারাই একমাত্র খেলোয়াড় নয় আর অস্ট্রেলিয়া এ খেলায় কোনো দর্শক মাত্র নয়। জাপান, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ভিয়েতনাম এবং প্যাসেফিক তাদের প্রত্যেকেরই এ খেলায় অংশ নেয়ার আগ্রহ আছে। আর অবশই এ খেলায় অংশ নেয়ার আগ্রহ আছে অস্ট্রেলিয়ার।

মরিসন বলেন, ১৯৩০ এবং ১৯৪০ সালে বিশ্ব এবং আঞ্চলিক ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে যায় এবং অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ে অষ্ট্রেলিয়া। আর বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া তার চেয়েও খারাপ অবস্থার মুখোমুখি। এ অঞ্চলে অস্ট্রেলিয়া যে বৈশ্বিক, অর্থনৈতিক আর কৌশলগত নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়েছে তা আগে কখনো দেখিনি আমরা। ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে দ্ব›দ্ব পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া ২০১৬ সালের হোয়াইট পেপারে এ অঞ্চল সম্পর্কে যে পরিকল্পনা এবং আশঙ্কা করেছিল তা দ্রুত পাল্টে গেছে।

কৌশলত প্রতিযোগিতা আর উত্তেজনার কেন্দ্র হলো ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চল। আমাদের এ অঞ্চল শুধু আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে না বরং আমাদের জীবদ্দশায় এ অঞ্চলই হবে বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতার কেন্দ্র। ভৌগোলিক দাবি নিয়ে গোটা ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়ছে। আমরা চীন এবং ভারতের মধ্যে সম্প্রতি সীমানা নিয়ে সংঘাত দেখেছি। এভাবে দ্বন্দ্ব রয়েছে দক্ষিণ চীন সাগর এবং পূর্ব চীন সাগরের সীমানা নিয়ে।

ইন্দো প্যাসেফিক অঞ্চলে চীনের সামরিক ঘাটি এবং অন্যান্য সামরিক অবকাঠামো নির্মান ঠেকানোর জন্য আঞ্চলিক বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সাথে অংশীদারিত্ব তৈরি করার ঘোষণা দিয়েছিলো অষ্ট্রেলিয়া। সিঙ্গাপুর, জাপান, দক্ষিন কোরিয়া, ভারত এবং ভিয়েতনামের সাথে সম্পর্ক জোরদারের কথাও জাননো হয়েছিলো।

ইন্দোনেশিয়ার সাথেও সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ নেয়ার কথা জানায় অস্ট্রেলিয়া। দেশটি চেষ্টা করছে ফিজি এবং সলোমন আইল্যান্ডে চীনের প্রভাব ঠেকানোর। এ ক্ষেত্রে পাপুয়া নিউি গিনিকে অস্ট্রেলিয়া ভবিষ্যত কৌশলগত মিত্র হিসেবে পেতে চায়। অস্ট্রেলিয়ার কৌশলবিদদের বিশ্বাস চীন দক্ষিণ প্যাসেফিক অঞ্চলে কমপক্ষে একটি সামরিক স্থাপনা তৈরি করতে চাচ্ছে।

ক্যানবেরার সমাবেশে দেশটির প্রধানমন্ত্রী অস্ট্রেলিয়ান ডিফেন্স ফোর্সকে উত্তর-পূর্ব ভারত মহাসাগর, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে পাপুয়া নিউগিনি এবং দক্ষিণ পশ্চিম প্যাসেফিক পর্যন্ত মনোনিবেশ করতে বলেছেন।

ওয়াশিংটনে অস্ট্রেলিয়ান পররাষ্ট্র মন্ত্রী চীন বিষয়ে যে বক্তব্য দিলেন তাতে চীন বিষয়ে অস্ট্রেলিয়ার নীতির বড় ধরনের পরিবর্তনের স্পষ্ট বার্তা রয়েছে। আর এটি হলে ভবিষ্যতে ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে চীনর-যুক্তরাষ্ট্র- ভারত লড়াইয়েও কিছুটা হলে নতুন সমীকরণ দেখা যেতে পারে
চীন বিষয়ে অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২৮ জুলাই। বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রী মাইক পম্পেও, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মার্ক এসপার, অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেরিস পেইন, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী লিন্ডা রেনল্ডস অংশ নেন। ছবি : রয়টার্স

 

অস্ট্রেলিয়া প্রধানমন্ত্রীর চীন বিরোধী সামরিক পরিকল্পনার পর ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চল ঘিরে সংঘাত নতুন মাত্রা পায়। এরপর গত জুলাই মাসে মাত্র ১৫ দিনের ব্যবধানে দক্ষিন চীন সাগরে যুক্তরাষ্ট্রের দুই বার ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপের টহল এবং ফিলিপাইন সাগর টহলে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অস্ট্রেলিয়ার যোগদান নিয়ে উত্তেজনা তীব্র আকার ধারন করে।

পরবর্তীতে কোয়াদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতি এবং ভারতের আসন্ন বার্ষিক মালাবার মহড়ায় অস্ট্রেলিয়া, জাপান যুক্তরাষ্ট্রের যোগদান নিয়েও ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলের রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ হয়।

এমন অবস্থায় ওয়াশিংটনে অস্ট্রেলিয়ান পররাষ্ট্র মন্ত্রী চীন বিষয়ে যে বক্তব্য দিলেন তাতে চীন বিষয়ে অস্ট্রেলিয়ার নীতির বড় ধরনের পরিবর্তনের স্পষ্ট বার্তা রয়েছে। আর এটি হলে ভবিষ্যতে ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে চীনর-যুক্তরাষ্ট্র- ভারত লড়াইয়েও কিছুটা হলে নতুন সমীকরণ দেখা যেতে পারে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে