নির্বাচনের আগে পুতিনকে ট্রাম্পের শেষ উপহার

রিপাবলিকানরাই অভিযোগ করেছেন নির্বাচনের আগে রাশিয়াকে একটি বড় উপহার দিলেন ট্রাম্প - ইন্টারনেট

  • মেহেদী হাসান
  • ০৯ আগস্ট ২০২০, ২০:১০

জার্মানি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য সরিয়ে আনা বিষয়ে নিজ দল রিপাবলিকানদের পক্ষ থেকেই তীব্র বিরোধীতার মুখে পড়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। রিপাবলিকানরাই অভিযোগ করেছেন নির্বাচনের আগে রাশিয়াকে একটি বড় উপহার দিলেন ট্রাম্প। অনেকের অভিযোগ ট্রাম্প নিজেই রাশিয়ার জন্য একটি উপহার। বিডি ভিউজ ইনফোটেইনমেন্টে স্বাগত জানাচ্ছি আমি সাবরিনা কাজী। জার্মানী থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য প্রত্যহারের নানামুখি প্রভাব নিয়ে আজ আমরা আলোচনা করবো।

জার্মানি থেকে সৈন্য সরিয়ে আনার ট্রাম্পের সিদ্ধান্তকে গভীর উদ্বেগজনক ঘটনা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন আমেরিকান অনেক রাজনীতি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক। তাদের অভিযোগ ট্রাম্প প্রশাসন আমেরিকার নিরাপত্তার বিষয়টি অবজ্ঞা করছেন। তার এ সিদ্ধান্তে খুশী হবে রাশিয়া। দুর্বল হবে ন্যাটো। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইউরোপের সম্পর্কের অবণতি ঘটবে। রাশিয়ার আগ্রাসনের মুখে পড়তে পারে ন্যাটো সদস্যদেশগুলো।

ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতির সব সময় বিরোধিতা করে আসছে রাশিয়া। ট্রাম্প রাশিয়ার সেই ইচ্ছা পূরণ করছেন। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সদর দফতর পেন্টাগন ঘোষনা দিয়েছে জার্মানি থেকে ১১ হাজার ৯০০ আমেরিকান সৈন্য সরিয়ে নেয়া হবে। একইসাথে যুক্তরাষ্ট্র আর্মির ইউরোপীয় মিলিটারি হেড কোয়ার্টার্স জার্মানি থেকে বেলজিয়ামে নিয়ে যাওয়া হবে।

জার্মানি থেকে সরিয়ে আনা সৈন্যদের মধ্য থেকে ৬ হাজার ৪০০ ফিরিয়ে আনা হবে যুক্তরাষ্ট্রে। আর ৫ হাজার ৬০০ মোতায়েন করা হবে ইউরোপের ন্যাটো সদস্য অন্যান্য দেশে। এরপর জার্মানিতে ২৪ হাজার আমেরিকান সেনা মোতায়েন থাকবে।

জামার্নির বিভিন্ন সামরিক ঘাটিতে বর্তমানে ৩৬ হাজার আমেরিকান সৈন্য, ২ হাজার ৬শ ন্যাশনাল গার্ড ও রিজার্ভ ফোর্স এবং প্রতিরক্ষা বিভাগের সাথে সংশ্লিষ্ট ১২ হাজার বেসামরিক আমেরিকান রয়েছে। জার্মানির চারটি রাজ্যে এসব ঘাটি রয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে জার্মানিতে মোতায়েন রয়েছে আমেরিকান সৈন্য। অনেকের মতে ইউরোপে আমেরিকান সৈন্যদের উপস্থিতির কারনে স্নায়ুযুদ্ধের সময় রাশিয়ার হামলা থেকে রক্ষা পেয়েছে ন্যাটো দেশগুলো। ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের মিলিটারি অপারেশনের বর্তমান কেন্দ্র হলো জার্মানি। এ ছাড়া আফ্রিকা এবং মধ্য প্রাচ্যের অপারেশনেরও কেন্দ্র এটি।

জার্মানি থেকে সৈন্য সরিয়ে নেয়াকে পেন্টাগনের তরফ থেকে কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ বলা হয়েছে। ট্রাম্পের অভিযোগ ন্যাটো প্রতিরক্ষা খাতে খরচে জার্মান তার অংশ পরিশোধ করেনি। তিনি বলেন ইউরোপের অনেক দেশ অনেক বছর ধরে আমাদের থেকে সুবিধা নিয়েছে। তারা কুকর্মকারী। তারা যদি তাদের পাওনা পরিশোধ করে তাহলে আমরা সিদ্ধান্ত পুনবিবেচনা করতে পারি।

জুনে যখন ট্রাম্প সৈন্য সরিয়ে আনার ঘোষণা দেন তখন হাউজ আমর্ড সার্ভিস কমিটির ২২ জন রিপাবলিকান সদস্য জার্মানি থেকে সৈন্য না সরানোর জন্য ট্রাম্পকে লিখিতভাবে অনুরোধ জানিয়েছেন। কারন এতে দেশটি রাশিয়ান আগ্রাসনের মুখে পড়বে এবং রাশিয়া সুবিধাজনক অবস্থায় চলে আসবে। চিঠিতে তারা লিখেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মোতায়েনকৃত যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যদের কারনে আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ ঠেকাতে সহায়তা করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে অধিকতর নিরাপদ করেছে। ইউরোপে রাশিয়ার হুমকি এখনো কমেনি। ন্যাটোর প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের উদাসনীতা রাশিয়াকে আগ্রাসনে উদ্বুদ্ধ করবে এবং রাশিয়ার জন্য সুবিধাজনক হবে।

রিপাবলিকান সদস্য লিজ চেনি বলেছেন, জার্মানি থেকে সৈন্য সরিয়ে আনা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর। রাশিয়া এবং চীনের হুমকি মোকাবেলা করে বিশ্বব্যাপী আমেরিকান নেতৃত্ব বজায় রাখা, মিত্র দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি করা এবং শান্তির স্বার্থে বর্হিবিশ্বে আমাদের উপস্থিতি জরুরি। সৈন্য সরিয়ে আনা আর মিত্রদের এভাবে ত্যাগ করার পরিণতি হবে ভয়ঙ্কর। যুক্তরাষ্ট্রের এ পদক্ষেপে উজ্জীবিত হবে শত্রুরা।

জার্মান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার বিষয়ে ট্রাম্প টুইট বার্তায় যা লিখেছেন তাতে এটি পরিষ্কার যে, তিনি জার্মানিকে শাস্তি দিয়েছেন। টুইট বার্তায় ট্রাম্প লিখেছেন, জার্মানি রাশিয়াকে জ্বালানি তেল বাবদ দিচ্ছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। আর আমরা জার্মানকে রাশিয়া থেকে রক্ষার জন্য সমর্থন দিয়ে যাচ্ছি। বিষয়টি তা হলে কী দাঁড়াল। এ ছাড়া তারা ন্যাটোর ২ শতাংশ চাদা না দেয়ার কুকর্ম করে যাচ্ছে। সুতরাং আমরা জার্মান থেকে কিছু সৈন্য সরিয়ে নিচ্ছি।

সিএনএন এর প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে ট্রাম্পের এই অক‚টনৈতিকসুলভ গ্রেনেড নিক্ষেপের ফলে জার্মানির সাথে সম্পর্কের যে অবণিত ঘটছে তা ঠিক হতে কয়েক বছর লাগতে পারে। জার্মান ফরেন রিলেশনস কমিটি প্রধান নরবার্ট রোয়েটজেন এক টুইট বার্তায় লিখেছেন, শক্তিশালী করার পরিবর্তে ন্যাটো জোট দুর্বল হচ্ছে।

২০১৭ সালে জানুয়ারিতে ট্রাম্প হোয়াইট হাউজে বসার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররা বড় ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে। কারন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভবিষ্যত সম্পর্ক কেমন হবে তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দেয়। ২০২০ সালের নির্বাচনে আবার যদি ট্রাম্প হোয়াইট হাউজে ফিরে আসেন তবে তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে তা কেউ অনুমান করতে পারছেন না।

জার্মানি থেকে ট্রাম্পের সৈন্য প্রত্যাহারের ঘটনায় রাশিয়া প্রথমে বিস্মিত হয়েছে। ইউরোপের ভীতিকর আর হতাশজনক অবস্থায় পরে রাশিয়া উৎফুল্ল হয়েছে । ক্রেমলিন মুখপাত্রের বক্তব্যে ফুটে উঠেছে রাশিয়ার এ চাপা আনন্দের বিষয়। সিএনএনকে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, এটা আমরা কখনো গোপন করিনি যে, ইউরোপে মার্কিন সৈন্য যত কম থাকবে ততই তা ইউরোপের জন্য কল্যানকর।

ন্যাটো বা যুক্তরাষ্ট্রের অন্য মিত্ররা ট্রাম্পকে থামাতে তেমন কিছু করতে পারবে না। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মার্ক এসপার বক্তব্য রাখছেন ঠিক ট্রাম্পের সুরে। তিনি বলেছেন জার্মানি হলো ইউরোপের সবচেয়ে ধনী দেশ। প্রতিরক্ষা খাতে তার আরো বেশি ব্যয় করা উচিত। এসপার বলেছেন, কিছু সৈন্য পোল্যান্ডে নেয়া হতে পারে। আর অন্য ছোট বাল্টিক দেশ থেকে সৈন্য পুরোপুরি সরিয়ে আনা হতে পারে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিত্র আর বাণিজ্যিক অংশীদার জার্মানী। জার্মানির সাথে ট্রাম্পের সম্পর্ক অবনতি শুধু ন্যাটো আর প্রতিরক্ষা খাতে খরচ কম নিয়ে নয়। বরং জার্মানির বিএমডব্লিউ গাড়ি রপ্তানি এবং বানিজ্যসহ আরো অনেক বিষয়ে ট্রাম্প ক্ষিপ্ত জার্মানির ওপর।

২০১৭ সালে হোয়াইট হাউজে প্রথম বৈঠকে ট্রাম্প চেষ্টা করেছেন এঞ্জেলা মার্কেলের প্রতি চোখাচুখি হওয়া এড়াতে। এমনকি এঞ্জেলা মার্কেলের সাথে হ্যান্ডশেক পর্যন্ত প্রত্যাখ্যান করেন ট্রাম্প। আর ২০১৮ সালে ন্যাটো বৈঠকের ব্রেকফাস্ট টেবিলে ট্রাম্প বিষোদগার করেন এঞ্জেলা মার্কেলকে।

ট্রাম্পের জেনারেলরা যুক্তরাষ্ট্র আর্মির ইউরোপ কমান্ডকে জার্মানি থেকে ব্রাসেলসে নিয়ে যাচ্ছেন যদিও বেলজিয়ামের প্রতিরক্ষা খাতের খরচ জার্মানির চেয়েও কম।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ট্রাম্প প্রশাসন বর্তমানে এশিয়ার দিকে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কিন্তু কৌশলগত কারন বা ট্রাম্পের স্বেচ্ছাচারিতা যে কারনেই জার্মানী থেকে সৈন্য সরিয়ে নেয়া হোক না কেন ইউরোপের দেশগুলোর নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া হবে। ইউরোপকে এখন নিজেদের নিরাপত্তার কথা নিজেদেরই ভাবতে হবে এবং এজন্য যাবতীয় আয়োজন তাদেরই করতে হবে। ফলে ইউরোপে বড় ধরনের কৌশলগত পরিবর্তন ঘটবে।

ইতোমধ্যে জার্মান প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বলেছেন একটি কমন ইউরোপীয় নিরাপত্তা এবং প্রতিরক্ষা নীতি গ্রহণের জন্য দ্রæত অগ্রসর হতে হবে। জার্মানী থেকে সৈন্য সরিয়ে নেয়ার ট্রাম্পের এ পদক্ষেপের ফলে এক রাতের মধ্যে যে ইউরোপ একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি করে ফেলবে তা নয়। তবে তারা এটি একদিন করবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তা ভাল হবে না।

সিএনএন এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্প শক্তিশালী করছেন রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে যে কিনা যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত শত্রু। আর পুতিন ইতোমধ্যে অফেনসিভ ভূমিকায় রয়েছেন। ট্রাম্প চাইছেন চীন আর ইরানের বিরুদ্ধে অবরোধ আরো জোরদার করতে এবং সেজন্য তার দরকার তার মিত্র ও বন্ধু দেশের সমর্থন। কিন্তু নিরাপত্তাহীন ইউরোপ চাইবে তাদের নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক বৃদ্ধি করে নিজেদের নিরাপত্তা আর বানিজ্য স্বার্থ রক্ষা করতে। আর এ লক্ষ্যে ইউরোপের পদক্ষেপ সব সময় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে নাও যেতে পারে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে