উইঘুর নিয়ে পাশ্চাত্যের খেলা

উইঘুরদের পাশে কেউ নেই - উইঘুর কার্টুন

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ২৩ জুলাই ২০২০, ২১:১৬

জিনজিয়াংয়ের মুসলিমদের ওপর চীনের নির্যাতনের কারণে পশ্চিমা বিশ্বের প্রবল চাপের মুখে রয়েছে যদিও এ ব্যাপারে নীরব মুসলিম বিশ্ব। সম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোতে এ ইস্যুতে অনেকটা সরব হয়ে উঠেছেন। তবে তাদের ভূমিকা কী মানবাধিকারের প্রতি অঙ্গীকারের প্রতিফলন নাকি ভূরাজনৈতিক খেলার অংশ, সেসব প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংসহ দেশটির নেতাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে গণহত্যার অভিযোগ দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।

জিনজিয়াং নিয়ে সম্প্রতি পাশ্চাত্য অনেকটা সোচ্চার হয়ে উঠেছে। চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট নেতাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। চীনও একই পদক্ষেপ নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সিনেটরসহ কয়েকজন রাজনীতিকের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে চীন। তবে দুটি দেশের এই পদক্ষেপ আসলে প্রতীকি। যুক্তরাজ্য সরকারও নিষেধাজ্ঞা আরোপের ইঙ্গিত দিয়েছে।

উইঘুর মুসলিমদের ওপর নির্যাতন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে চীনের শক্তিশালী পলিটব্যুরোর এক সদস্যসহ দেশটির চার কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, চীনের এসব কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হবে। এর আগে তিনি জিনজিয়াংয়ে চীনের বর্বরতাকে শতাব্দীর কলঙ্ক বলে মন্তব্য করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, জিনজিয়াং প্রদেশে ১০ লাখেরও বেশি মুসলিমকে বন্দিশিবিরে আটকে রেখে নির্যাতন করা হচ্ছে।

জিনজিয়াংয়ের সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিম স¤প্রদায়ের ওপর নির্মম নির্যাতন ও গণহত্যা চালানো হচ্ছে বলে জানিয়েছে নির্বাসনে থাকা উইঘুরদের একটি দল। তারা উইঘুরদের ওপর গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত আইসিসির প্রতি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংসহ দেশটির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন।

জুলাইয়ের প্রথমদিকে জিনজিয়াংয়ের দুইজন নেতাকর্মী উইঘুরের পক্ষে লন্ডনের আইনজীবীদের মাধ্যমে নতুন প্রমান জমা দিয়েছেন। ৮০ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রে লন্ডনভিত্তিক আইনজীবীরা জানিয়েছেন, জিনজিয়াংয়ে চীন গণহত্যা চালাচ্ছে।

চীন আইসিসির সদস্য নয়। রীতি অনুযায়ী চীনের বিরুদ্ধে এ আদালতে মামলা চলতে পারে না। তবে আইনজীবীরা যুক্তি দেখান যে এই ধরনের অপরাধের একটি অংশ কম্বোডিয়া এবং তাজিকিস্তানে সংঘটিত হয়েছে। আর এই দেশ দুটি আইসিসির রোম বিধিতে স্বাক্ষরকারী। ফলে চীন এই আদালতের সদস্য না হলেও আন্তর্জাতিক আদালত এই মামলাগুলোর বিচার করার অধিকার রাখে।

একই যুক্তিতে আইসিসি রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানোর অপরাধে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা গ্রহণ করে তদন্ত শুরু করেছে। মিয়ানমারও আইসিসির সদস্য নয়। তবে আদালত বলেছে, বাংলাদেশ আইসিসির সদস্য আর রোহিঙ্গাদেও ওপর নিপীড়নের প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশে। তাই এ মামলা চলবে। অভিযোগপত্রে আদালতকে উইঘুর, কাজাখ, কিরগিজ এবং অন্যান্য তুর্কি জনগোষ্ঠীর লোকজনের গুম হওয়া, গণগ্রেপ্তার, শিশুদের তাদের পরিবার থেকে রাষ্ট্রীয় এতিমখানাগুলোতে জোর করে স্থানান্তর, তুর্কি ভাষা নির্মূল করার পরিকল্পনা, গণ নজরদারি এবং অন্যান্য অপরাধ তদন্তে জন্য জোর দাবি জানানো হয়েছে।

গুরুতর এসব অভিযোগের সাথে জড়িতদের নামের তালিকায় প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংসহ ৩৪ চীনা কর্মকর্তাকে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তাদের নির্দেশেই এই অপরাধগুলো হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আদালতে অভিযোগকারী উইঘুর দলটি জানিয়েছে, তারা আশা করেন এই আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তারা উইঘুর মুসলিমদের ওপর চীন সরকারের চালানো গণহত্যা বন্ধ করতে সক্ষম হবেন ।

এদিকে জিনজিয়াং নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের ক্রমবর্ধমান সমালোচনার মধ্যেই জাতিগত সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠী উইঘুরদের জন্মহার নিয়ন্ত্রণে রাখতে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে চীন। নতুন এক তদন্তে দেখা গেছে, মুসলমান জনসংখ্যা সীমিত রাখতে উইঘুর নারীদের পরিকল্পিতভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণে বাধ্য করা হচ্ছে। এমনকি গর্ভপাতে বাধ্য হচ্ছেন হাজার হাজার নারী। সরকারি পরিসংখ্যান, রাষ্ট্রীয় নথি, সাবেক বন্দি, পরিবারের সদস্য এবং বন্দিশিবিরেরর সাবেক পরামর্শকের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মার্কিন বার্তা সংস্থা এপি। তবে চীন একে যথারীতি ‘ভুয়া খবর’ বলে আখ্যা দিয়েছে।

উইঘুর জনগোষ্ঠীকে বন্দিশিবিরে আটক রেখে নিয়মিত তাদের কাঠ ও তারের চাবুক দিয়ে পেটানো হয়। শরীরে সুই ফুটানো ও প্লাস দিয়ে নখ তুলে নেওয়া হয়। বেইজিং কর্তৃপক্ষ এগুলোকে ‘পুনঃশিক্ষা কেন্দ্র’ আখ্যা দিয়ে থাকে।

গত চার বছরের বেশি সময় ধরে পশ্চিমাঞ্চলীয় জিনজিয়াংয়ে চীন যে অভিযান চালাচ্ছে তাকে অনেক বিশেষজ্ঞই ‘জনতাত্তি¡ক গণহত্যার’ একটি ধরণ বলে মনে করেন।

বার্তা সংস্থা এপির অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চীন নিয়মিতভাবে সংখ্যালঘু নারীদের গর্ভ পরীক্ষা এবং বন্ধ্যা হতে বাধ্য করেছে। বহু মানুষকে বন্দিশিবিরে পাঠানোর অন্যতম কারণ বেশি সন্তান থাকা। তিন বা তার বেশি সন্তান থাকলে বিপুল পরিমাণ জরিমানা দিতে ব্যর্থ হলে বাবা-মায়েদের ডিটেনশন সেন্টারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আবার লুকিয়ে রাখা সন্তান খুঁজে বের করতে পুলিশ বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালায়, বাবা-মাকে ভয়ও দেখায়। চীন সরকারের সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী দেখা গেছে, উইঘুর অধ্যুষিত হোতান ও কাশগর অঞ্চলে জন্মহার ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ৬০ শতাংশ কমে গেছে। জিনজিয়াং প্রদেশজুড়ে গত বছরই জন্মহার কমেছে ২৪ শতাংশ।

দুর্ভাগ্যজনক হলো, জিনিজয়াংয়ে চীনের বর্বরতা নিয়ে মুসলিম বিশ্ব শুধু নীরবতাই পালন করে না, অনেক ক্ষেত্রেই চীনকে জোরালো সমর্থন দেয়। সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান চীনা সংখ্যালঘু বিষয়ক নীতির প্রশংসাও করেছেন৷ অন্য আরব দেশগুলোরও অবস্থান একই রকম। ইরান চীনা নীতির সমালোচনা করে না। ইরান থেকে তেলের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক চীন, ইরানের তেল ও গ্যাস খাতেও চীন প্রচুর বিনিয়োগ করে। ইরানের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক আরো প্রসারিত করছে দেশটি। চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কও সুগভীর।

বিশ্লেষকরা বলছেন, মিশরসহ অনেক মুসলিম দেশই পরিচালিত হয় অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচার সরকার দ্বারা। ফলে তাদের প্রায়ই মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য পশ্চিমা দেশগুলির সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। অন্যদিকে, চীন মানবাধিকার সম্পর্কিত বিষয়ে মোটেই আগ্রহী নয়। ফলে চীনের সঙ্গে যে কোনো দেশই একে অপরের অভ্যন্তরীণ নীতি নিয়ে সমালোচনার ভয় না করেই ব্যবসা করতে পারে৷

চীনের অর্থনীতির রমরমা অবস্থা এবং তাদের কাছ থেকে নানান সুবিধা পেয়ে বোবা হয়ে আছে অধিকাংশ মুসলিম দেশ। বুদ্ধিজীবীরাও কথা বলেন না। আসলে মুসলিমদের ব্যাপারে বরাবরই মুসলিম সুশীল সমাজ একরকম অন্ধ। এসব নিপীড়িত মুসলিম মানুষের কান্না তাদের কানে যায় না।

তবে কয়েক বছর আগে তুরস্ক উইগুরদের জাতিগত সংগ্রামকে সমর্থন করে। এমনকি ২০০৯ সালে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিজেপ তায়্যেপ এরদোয়ান জিনজিয়াং-এ চীনা নীতিকে 'গণহত্যা' হিসাবে অভিহিত করেছিলেন। অনেকদিন ধরে জিনজিয়াংয়ের শরণার্থীদের আশ্রয়ও দিয়ে আসছে তুরস্ক৷ দেশটি থেকে উইঘুর নেতাদের রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালানোর সুযোগও দেওয়া হয়েছিল।

তবে পশ্চিমা বিশ্ব তুরস্ককে নানাভাবে চাপে রাখার কারণে আঙ্কারা চীনের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হয়েছে। ফলে তুরস্কের জিনজিয়াং নীতিতে কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এরপরও এখনও বিপুল সংখ্যক উইঘুর নিরাপদে তুরস্কে অবস্থান করছে।

উইঘুরদের বিরুদ্ধে চীনের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে সবচেয়ে বেশি আওয়াজ উঠছে পশ্চিমা দেশগুলো থেকেই। তবে নিন্দা করে বিবৃতি দেওয়া ছাড়া কোনো দেশ তেমন কিছু করেনি। যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি কিছুটা প্রতীকি পদক্ষেপ নিলেও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জিনপিংয়ের সঙ্গে একান্ত বৈঠকে চীনের জিনজিয়াং নীতিকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেছেন। ট্রাম্পের সাবেক নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বল্টন তার সাম্প্রতিক বইতে লিখেছেন যে জিনপিংকে ট্রাম্প বলেছিলেন, জিনিজয়াংয়ে বন্দিশিবির তৈরি সঠিক পদক্ষেপ।

বাস্তবতা হচ্ছে জিনজিয়াং নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর কোনো সমন্বিত নীতি নেই। চীনের ক্রমবর্ধমান উত্থান ঠেকাতে তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে। জিনজিয়াং নিয়ে তাদের পদক্ষেপও এই আলোকেই দেখতে হবে। চীনকে কোণঠাসা রাখাই তাদের উদ্দেশ্য, উইঘুরদের নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের আসলে কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না।

১৯১১ সালে মাঙ্কু সাম্রাজ্য উৎখাতের মাধ্যমে আজকে জিনজিয়াং নামে পরিচিত তৎকালীন পূর্ব তুর্কিস্তানে চীনা শাসন চালু হয়। কিন্তু রক্তে মিশে থাকা স্বাধীনচেতা স্বভাবের উইঘুররা এই ঔপনিবেশিক শাসনের বশ্যতা মানেনি। ১৯৩৩ ও ১৯৪৪ সালে তারা দুবার চীনাদের সঙ্গে সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করে স্বাধীনতা অর্জন করে। কিন্তু ভাগ্য তাদের অনুকূলে ছিল না। এ কারণে ১৯৪৯ সালে আবারও তারা মাও সেতুংয়ের চীনা কমিউনিস্টদের হাতে পরাজিত হয়।

উইঘুরদের নিয়ে তামাশা। ছবি : উইঘুর কার্টুন
উইঘুরদের নিয়ে তামাশা। ছবি : উইঘুর কার্টুন

 

মধ্যযুগে তুর্কিস্তানে ইসলাম ও আরবের প্রভাব বাড়তে থাকে। স্থানীয় উইঘুর জনগোষ্ঠীর বিপুলসংখ্যক লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। উইঘুরকেই এখন চীনের মুসলিম জনগোষ্ঠী বোঝানো হয়। সিআইএর ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্ট বুক অনুযায়ী, চীনের মোট জনসংখ্যার ১ থেকে ২ শতাংশ মুসলিম। ২০০৯ সালের এক হিসাব অনুযায়ী, চীনের জিনজিয়াংয়ে ১ কোটি ২০ হাজারের মত উইঘুর লোক বসবাস করে। তাদের বেশিরভাগই মুসলিম।

জিনজিয়াং চীনের কাছে ভৌগলিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মধ্য এশিয়ায় চীনের প্রবেশপথ হচ্ছে এ অঞ্চল। কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান ও আফগানিস্তান, মঙ্গোলিয়া ও রাশিয়া সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চলটির উত্তওে পাকিস্তান ও দক্ষিণে ভারত। উইঘুর মুসলিমরা জিনজিয়াংকে এখনো পূর্ব তুর্কিস্তান বলে থাকেন। তাদের আশা, বৈশ্বিক নানা সমীকরণে একদিন বর্বর চীনের শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীন হবে জিনজিয়াং।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে