ইরান কেন ভাঙবে না

গত মার্চে তেহরানে এক ইরানী তরুণীর পতাকা প্রদর্শন - এএফপি

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ২২ জুলাই ২০২০, ২২:১৪

ইরান নামের দেশটির বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের অভিযোগ ও অবরোধের শেষ নেই। পশ্চিমারা একা নয়, এ কাজে তাদের দোসর হিসেবে আছে ইরানেরই প্রতিবেশী দেশগুলোও। সেই সুদূর ১৯৭৯ সালে 'ইসলামী বিপ্লব' সংঘটিত হওয়ার পর থেকেই পশ্চিমাদের চক্ষুশূল হয়ে আছে দেশটি। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে ১৯৮০এর দশকে ইরানের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া হলো ইরাককে। ইরাকের সাথে দীর্ঘ আট বছরের যুদ্ধেও কাবু করা গেলো না ইরানকে। তারপর নানা রকম অর্থনৈতিক অবরোধ তো আছেই।

এসব নিয়েই আজ বহু বছর ধরে টিকে আছে ইরান। কিন্তু কীভাবে আছে, কেমন আছে দেশটি? কী ঘটছে দেশটিতে? কিভাবে কোভিড-১৯ মোকাবিলা করছে তারা? আমেরিকার 'সর্বোচ্চ নির্দয় চাপের' মুখে টিকেই বা আছে কীভাবে?

এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে এক বিদেশী সাংবাদিক ফোন করেছিলেন ইরানের তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মোহাম্মদ মারান্দির কাছে, যাঁকে বলা হয় ইরানের অন্যতম সেরা বিশ্লেষক এবং নিজ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও রয়েছে তাঁর।

প্রফেসর মারান্দি বলেন, বিপ্লবের পর সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সার্বিক সাফল্য পেয়েছে ইরান। কিউবার মতো ইরানও প্রতিষ্ঠা করেছে একটি ব্যাপকভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা নেটওয়ার্ক। তবে এ কাজে অর্থ যোগান দেয়া হয়েছে কিউবার চাইতে অনেক বেশি। গড়ে তোলা হয়েছে একটি বৃহৎ হসপিটাল নেটওয়ার্ক।

প্রফেসর মারান্দি জানান, করোনা ভাইরাসের প্রকোপ যখন শুরু হলো, তখন আমেরিকা এমনকি চেষ্টা করেছিল যেন ইরান টেস্ট কিট যোগাড় করতে না-পারে। কিন্তু ইরান পেরেছে এবং সেটা বেসরকারিভাবে নয়, সরকারিভাবেই।

তিনি বলেন, করোনাকালেও ইরান কিন্তু পুরোপুরি শাটডাউন করেনি। সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। টেস্ট কিট, ফেস মাস্ক থেকে শুরু করে যা কিছু প্রয়োজন, সবই এখন উৎপাদন করছে ইরান। আমাদের হাসপাতালগুলোতে যান, কোনোটিই করোনা রোগীতে ভরপুর - এমনটি দেখবেন না।

আলীরেজা হাশেমী নামে স্থানীয় এক নীতি বিশ্লেষক বলেন, ইরানের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যাব্যবস্থা হাজার হাজার শহর-নগর-গ্রাম পর্যন্ত প্রসারিত, যেখানে রয়েছে অসংখ্য পাবলিক ক্লিনিক, হেলথ হাউস ও হেলথ সেন্টার। এভাবেই সরকার সহজেই জনগণকে মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকে।

ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় শুরুতেই একটি কোভিড-১৯ কল সেন্টার স্থাপন করে ত্রাণদাতাদের দেয়া প্রতিরোধমূলক সরঞ্জাম জনগণের মাঝে বিতরণ করতে থাকে। দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী জনগণের সাহায্যার্থে সেনা মোতায়েনের নির্দেশ দেন। রাস্তাঘাট ও পাবলিক প্লেসগুলো জীবাণুমুক্ত করতে তিন লাখ সেনা ও স্বেচ্ছাসেবী মোতায়েন করা হয়। স্যানিটাইজার ও মাস্ক বিতরণ করা হয় এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়।

ফেস মাস্ক ও অন্যান্য সরঞ্জাম উৎপাদনের লক্ষ্যে একাধিক প্রোডাকশন লাইন স্থাপন করে ইরানের সেনাবাহিনী। তেহরান চেম্বার অব কমার্সকে সাথে নিয়ে কয়েকটি এনজিও শুরু করে 'নাফাস' বা নিঃশ্বাস নামে একটি ক্যাম্পেইন বা প্রচারাভিযান। তেহরানের স্টক মার্কেটও বিভিন্ন মেডিক্যাল ডিভাইস ক্রয় ও উৎপাদনের জন্য একটি গণতহবিল গঠন করে। 'জিহাদি' নামে পরিচিত শত শত স্বেচ্ছাসেবী স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য নিরাপত্তাসরঞ্জাম এমনকি ফলের জ্যুসও বানাতে থাকে। এগুলো পরে বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা ও মাজারে পৌঁছে দেয়া হয়। সামাজিক সংহতির এ ধারণা ইরানী সংস্কৃতিরই অংশ। আর কোভিড-১৯এর হানা এতোটাই তীব্র ছিল যে, এর মোকাবিলায় ইরানের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক সংহতির ধারণাটি নতুন রূপ পরিগ্রহ করে। ব্যক্তি এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সরকার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।

এভাবে গোটা দেশটি করোনা অতিমারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ায় এক মাস আগেই স্বাস্থ্য বিষয়ক কড়াকড়ি শিথিল করে ইরান সরকার। সাম্প্রতিক কয়েক সপ্তাহে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার স্বাদ পাচ্ছে ইরানবাসী। তবে লড়াই এখনও শেষ হয়নি। পাশ্চাত্যের মতো ইরানেও করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা লাগার আশঙ্কা রয়ে গেছে।

করোনা অতিমারীর কারণে ইরানের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলেন, হ্যাঁ, ক্ষতি তো কিছুটা হবেই। তবে অর্থনীতির সবচাইতে বড় ক্ষতিটা হয়েছে অবরোধের কারণে এবং সেটা ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। ইরানের অর্থনীতি তেল বিক্রির টাকা ছাড়াই চলতে পারছে।

এক বিশেষজ্ঞ এ প্রসঙ্গে বলেন, তেল বিক্রির টাকা না-থাকায় চলতে না-পারার কোনো চিহ্ন আপনি তেহরানে দেখতে পাবেন না। সউদি আরব, ইরাক, তুরস্ক অথবা সংযুক্ত আরব আমীরাতের সাথে আমাদের তুলনা চলে না। আপনি দেখুন, পাকিস্তান ও ইন্ডিয়ান শ্রমিকরা দলে-দলে উপসাগরীয় এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আর দুবাই তো এখন মৃত।

তিনি বলেন, করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় ইরান অন্য অনেক দেশের তুলনায় ভালোই সাফল্য অর্জন করেছে। গত বছর এবং এ বছরও আমাদের শস্য উৎপাদন ভালো হয়েছে। অন্য যে-কোনো সময়ের তুলনায় ইরান এখন বেশি স্বনির্ভর।

পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী ও তাদের প্রচারমাধ্যম প্রায়ই এ রকম একটি প্রচার চালিয়ে থাকে যে, বিপ্লবের পর থেকে অর্থনৈতিক দুর্দশা ইরানীদের পিছু ছাড়ছে না। কিন্তু প্রবীন ইরানীরা জানেন, ১৯৮০এর দশকে ইরাকের সাথে চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধকালে যে দুর্দশা ভোগ করতে হয়েছিল, সে-তুলনায় এখন অবস্থা অনেক ভালো।

ইরানের রাষ্ট্রীয় বাজেট পরিকল্পনার দায়িত্বে নিয়োজিত একজন কর্মকর্তা জুন মাসের গোড়ার দিকে মজলিশ বা সংসদকে জানান, নতুন বাজেটে তেলনির্ভরতা কমানো হবে এবং তেলের আয় ছাড়াই দেশ চালানোর কর্মসূচি দেয়া হবে।

ওই কর্মকর্তা আরও জানান, এক দশক আগে তেল ও তেলজাত পণ্য থেকে ইরানের আয় ছিল ১১৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এখন তা কমে গিয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরে আয় হয়েছে মাত্র আট দশমিক নয় বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এভাবে গোটা ইরানের অর্থনীতি পাল্টে যাচ্ছে। এ পরিবর্তনের যেটা বিশেষ কৌতূহলোদ্দীপক তা হলো ইরানের পণ্য উৎপাদনক্ষেত্রে বিস্ফোরণ। ইরানের কম্পানিগুলো এখন রফতানির পরিবর্তে দেশীয় বাজারের দিকে মনোযোগ দেয়ায় এটা সম্ভব হয়েছে।

২০১৯-২০ অর্থবছরে তেলবহির্ভূত পণ্য রফতানি থেকে ইরানের আয় হয়েছে ৪১ দশমিক তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিপ্লবোত্তর ইরানে এই প্রথমবার তেলবহির্ভূত পণ্য রফতানি আয় তেল রফতানি আয়কে ছাড়িয়ে গেল। অবরোধের মাধ্যমে ইরানের ওপর ''ম্যক্সিমাম প্রেসার'' প্রয়োগের যে কৌশল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন নিয়েছে, তা সফল হয়েছে মাত্র সাত শতাংশ। সব চাপ মোকাবিলা করে ইরানের রফতানি এখন ইতিহাসের যে কোনো সময়ের চাইতে বেশি।
ইরান চেম্বার অব কমার্সের দেয়া এক উপাত্তে জানানো হয়, আংশিক লকডাউন তুলে নেয়ার পরের মাস থেকেই দেশের শিল্পপণ্য উৎপাদকরা আবার তাদের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

বাস্তবতা হলো, ইরানী উৎপাদকরা ভোগ্যপণ্য থেকে শিল্পপণ্য সবকিছুই উৎপাদন করে থাকেন। এর মাঝে আছে কুকিজ থেকে শুরু করে স্টেইনলেস স্টীল পর্যন্ত সবই। উৎপাদকরা এসব রফতানি করে থাকেন বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া, চীন ও রাশিয়ায়। 'ইরান এখন একঘরে হয়ে পড়েছে' বলে পশ্চিমারা যে গালগপ্প বলে, সেটা আসলেই গালগপ্প ছাড়া আর কিছুই নয়।

এছাড়া ইরানের রফতানি পণ্যের তালিকায় সামনের দিনগুলোতে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ নাম সংযোজিত হতে যাচ্ছে। এর একটি হলো টিটেনিয়াম। এটি সামরিক, মহাকাশ ও সমুদ্রবিজ্ঞান শিল্পে এবং সাধারণ শিল্পে কাজে লাগে। ইরানের ওয়েস্ট আজারবাইজান প্রদেশের রাজধানী উরমিয়ার ক্বারা-আঘাজ খনিতে বিপুল পরিমাণ অনাহরিত টিটেনিয়ামের মজুত রয়েছে।

বিশ্বের শীর্ষ ১৫টি খনিজ সম্পদসমৃদ্ধ দেশের একটি হলো ইরান। গত জানুয়ারিতে গভীর খনি খননের প্রযুক্তি হাতে পায় ইরান। এরপরই তারা মাটির নিচের দুষ্প্রাপ্য খনিজ সম্পদ আহরণে একটি পাইলট প্রজেক্ট চালু করে।

তবে টিম ট্রাম্পের চাপাচাপি কিন্তু শেষ হয়নি। গত জানুয়ারি মাসেই ইরানের ''কনস্ট্রাকশন, মাইনিং, ম্যানুফ্যাকচারিং ও টেক্সটাইল শিল্পকে'' টার্গেট করে আরও একটি নির্বাহী আদেশ জারি করে হোয়াইট হাউস। এখন টিম ট্রাম্পের লক্ষ্য হচ্ছে ইরানের বিস্ফোরণশীল প্রাইভেট সেক্টরকে থামিয়ে দেয়া। এতে সফল হলে ইরানের অসংখ্য ব্লূ কলার শ্রমজীবী ও তাদের পরিবার দুর্দশায় পড়ে যাবে। প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানীর সরকারের তখন ''নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে'' বলা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না।

অবশ্য শুধু-যে ইরান সরকারের নয়, আমেরিকার ট্রাম্প প্রশাসনের নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার মতো খবরও আছে। তা হলো, দু'দেশের মধ্যকার কিছু মতপার্থক্যকে দূরে সরিয়ে রেখে ইরান-চায়না কম্প্রিহেনসিভ স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ বা সিএসপি এখন কাজ করতে শুরু করেছে। দুই দুশমনের এমন মৈত্রীতে আমেরিকার স্বস্তিতে শ্বাস নেয়ার জো আছে?

চীন-ইরান এই যৌথ পথচলার পরবর্তী পরীক্ষাটি হবে আগামী সেপ্টেম্বরে। ওই সময় ইরানের ওপর জাতিসংঘের আরোপিত নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বাড়াতে চাইবে টিম ট্রাম্প। কিন্তু জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সব সদস্য দেশ যদি আমেরিকার ওই উদ্যোগে সায় না-দেয়, তাহলে আগামী অক্টোবরেই নিষেধাজ্ঞাটির মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে।

চীন তখন কোন পথে যাবে, তা এখনই বলে দেয়া যায়। চীন, রাশিয়া ও ইরান হচ্ছে ইউরেশিয়ান ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু। রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক - উভয়ভাবে তারা একইরকম সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। কাজেই জুন মাসে মস্কোয় ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফের সাথে বৈঠক শেষে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সারগেই লেভরভ যখন বলেন, ''ইরানকে শাস্তি দেয়ার কোনো অধিকার আমেরিকার নেই'' তখন কেউ খুব অবাক হন না।

তবে চীন ও রাশিয়া এখন পর্যন্ত ইরানকে সমর্থন দিয়ে গেলেও পর্যবেক্ষকদের অনেকে মনে করেন, ইরানের ক্রমাগত শক্তি অর্জনকে একই সাথে ভয়ও পায় রাশিয়া। কারণ, মধ্যপ্রাচ্যে হালে রাজনৈতিক ইসলামকে কেন্দ্র করে যে অক্ষটি গড়ে উঠেছে, ইরান এতে আছে। ইরানকে সাহায্য করা থেকে রাশিয়া যদি কোনো সময় পিছিয়ে আসে তাহলে এ কারণেই আসবে।

বিপদ ঘনিয়ে আসছে অন্য দিক থেকেও। গত সপ্তাহে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থায় ফ্রান্স, ব্রিটেন ও জার্মানির আনা একটি প্রস্তাব পাস হয়, যাতে ইরানের সমালোচনা করা হয়েছে। ২০১২ সালের পর এ ধরনের ঘটনা এটাই প্রথম। এটাকে ইরানের জন্য একটা বিপদসঙ্কেত বলা যেতে পারে।

সব মিলিয়ে এ রকমই আছে ইরান; প্রায়-বন্ধুহীন অথচ সতত লড়াকু।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে