আমেরিকার সেই দিন আর নেইে

মাস্ক পরা নিয়ে আমেরিকান সমাজ বিভক্ত হয়ে পড়ছে - টুইটার

  • মেহেদী হাসান
  • ০৮ জুলাই ২০২০, ২৩:১৫

লিখিত আইন হলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আমেরিকা শাসন করবেন। আর অলিখিত আইন হলো তিনি বিশ্ব শাসন করবেন। কিন্তু সেই দিন আর নেই। অনেকের মতে আমেরিকান আধিপত্যর বিস্তারের বাইরে চলে যাচ্ছে বিশ্ব । যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক ক্ষমতা আর আধিপত্য বিস্তারের ক্ষমতাও কমে আসছে।

আমেরিকানরা এখন বিভক্ত আর দ্বন্দে লিপ্ত এমনকি করোনাকালে মাস্ক পরা নিয়েও দেখা দিয়েছে দ্বন্দ্ব। যারা মাস্ক পরে তাদেরকে ট্রাম্পবিরোধী হিসেবে দেখা হচ্ছে। ২০২০ সালকে যুক্তরাষ্ট্রের ইতহাসে অন্যতম একটি অন্ধকারতম বছর হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন অনেক বিশ্লেষক। করোনার কারণে ইউরোপীয় ইনিয়নসহ মিত্র দেশে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। এ সিদ্ধান্ত আমেরিকানদের জন্য কলঙ্কজনক হিসেবে মনে করেন অনেক আমেরিকান। এরমধ্যে দেশটিতে বেকারত্ব সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছেছে। মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রে কর্মক্ষম মানুষের মধ্যে বেকারত্বের হার পৌছায় ৪৭ দশমিক ২ ভাগ । বুরো অব লেবার স্টাটিসটিকসের প্রকাশিত তথ্য এটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এত উচ্চ বেকারত্বের হার যুক্তরাষ্ট্রে এই প্রথম।

জর্জ ফ্লয়েড হত্যা ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদ, বর্ণবৈষম্য, আর কালোদের নির্বিচার হত্যার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র আজ অনেকের কাছে একটি হীন আর অমর্যাদাকর দেশে পরিণত হয়েছে । এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে গোটা ইউরোপসহ বিশ্বব্যাপী মানুষ রাস্তায় প্রতিবাদ আর নিন্দা জানিয়েছে সুপার পাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। চীনের উইঘুরদের ওপর নির্যাতন আর হংকংয়ের ঘটনায়ও এভাবে ইউরোপীয়রা রাস্তায় নামেনি। আর চরম এ দুঃসময়ে যুক্তরাষ্ট্রকে টেনে তোলার জন্য নেই কোনো নেতা যেমনটা ১৯৩৩ সালের মহামন্দার সময় ছিলেন ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট। বরং সামনের নির্বাচনে যেসব প্রার্থীর জয়ী হবার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে তাতে যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যত আরো অন্ধকারাচ্ছন্ন মনে করছেন বিশ্লেষকরা। যুক্তরাষ্ট্রকে এখন অনেকে তুলনা করেন এমন একজন অভিনেতা হিসেবে যিনি আর কোনো মুখ্য চরিত্রের ভূমিকায় নেই। কিন্তু তার পেছনে এখনো দৌড়ায় পাপারাজ্জি। যুক্তরাষ্ট্রের চরম ডানপন্থী একটি সংস্থা হুমকি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দিন শেষ । সামনে অপেক্ষা করছে গৃহযুদ্ধ।

আমেরিকানরা কতোটা বিভক্ত করেনারা সময়ে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মাস্ক পরা নিয়ে আমেরিকান সমাজ বিভক্ত হয়ে পড়ছে। যারা মাস্ক পরে তাদেরকে ট্রাম্পবিরোধী হিসেবে দেখা হচ্ছে। কারণ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মাস্ক পরিধান বিরোধী। দেশটির প্রেসিডেন্ট আর ভাইস প্রেসিডেন্ট দীর্ঘ দিন ধরে মানুষকে উৎসাহিত করছেন মাস্ক না পরতে । এজন্য প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট হাসপাতাল ও কারখানা সফর করেছেন মাস্ক পরিধান না করে । অতীতে আমেরিকান সমাজ এভাবে বিভক্ত ছিলো না।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সামাজিক মাধ্যমে সরাসরি লিখিত বার্তা দিয়েছেন লকডাউন ভেঙে আমেরিকানদের রাস্তায় নামার জন্য। আমেরিকাকে লকডাউন থেকে মুক্ত করার জন্য। ফলে লকডাউনের পক্ষে বিপক্ষেও আমেরিকানরা রাস্তায় সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে। একটি দেশের প্রেসিডেন্ট তার দেশের নাগরিরকদের জন্য আইন ভঙ্গের জন্য লিখিতভাবে উৎসাহিত করছেন। আর এ দেশটি হলো সুপার পাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রে।

চার মাসের অধিক সময় ধরে করোনায় বিপর্যস্ত যুক্তরাষ্ট্র। আর ৪ মাসের মাথায় যুক্তরাষ্ট্র করোনা নিয়ে এক অদ্ভুত আর বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার চার ভাগের এক ভাগ বাস করে যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু বিশ্বে করোনায় যত মানুষ আক্রান্ত হয়েছে তার ২৫ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রে। একইভাবে বিশ্বে করোনায় যত মানুষ মারা গেছে তারও ২৫ শতাংশ মারা গেছে যুক্তরাষ্ট্রে। ১৫ এপ্রিল ২৪ ঘন্টায় যুক্তরাষ্ট্রে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় ২ হাজার ৬। আর ১৫ এপ্রিল বুধবার হোয়াইট হাউজে নিয়মিত ব্রিফিংয়ের সময় ট্রাম্প বলেন, যুক্তরাষ্ট্র দেশব্যাপী সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি পার হয়ে এসেছে। আমাদের অর্থনীতি পুনরায় খুলে দেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র শক্ত অবস্থানে রয়েছে।

১৭ এপ্রিল ট্রাম্প এক টুইট বার্তায় তিনটি রাজ্যের নাম উল্লেখ করে সেগুলোকে লকডাউন থেকে মুক্ত করার আহবান জানান। ট্রাম্পের আহবানের পর বিভিন্ন রাজ্যে ট্রাম্প ভক্ত আর লকডাউন বিরোধীরা রাস্তায় বিক্ষোভ শুরু করে লকডাউন তুলে নেয়ার জন্য। বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে লকডাউন বিরোধী বিক্ষোভ। অনেক রাজ্যে সংঘাতের ঘটনা ঘটে লকডাউনের পক্ষে বিপক্ষে সর্মকদের মধ্যে। এরই মধ্যে ট্রাম্প লকডাউন বিরোধী বিক্ষোভকারীদের প্রশংসা করে টুইট বার্তা ছাড়া অব্যাহত রাখেন। যেসব রাজ্যে লকডাউন নিয়ে কড়াকড়ি আরোপ করা হয় সেসব রাজ্য গর্ভনরদের প্রতি তীব্র বিষোদগার করেন ট্রাম্প।

লকডাউন বিরোধীরা বিক্ষোভের সময় করোনা আর মাস্ক পরিধান নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রæপের পোস্টার বহন করে। লকডাউন তুলে নেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে এভাবে রাস্তায় মানুষের মিছিল দেখে অনেকে মন্তব্য করেন তারা মরার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। মৃত্যু তাদের টানছে আর সে কারনে তারা অন্ধ হয়ে গেছে। বাস্তবেও এমনটাও ঘটেছে।

ট্রাম্পের চাপাচাপিতে এপ্রিলের শেষের দিক হতে বিভিন্ন রাজ্যে লকডাউন শিথিল হতে থাকে। ৬ মে থেকে অধিকাংশ রাজ্যে লকডাউন তুলে নেয়া শুরু হয়। লকডাউন তুলে নেয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রে আবার ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে থাকে করোনা ভাইরাস। ১৫ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় মোট মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৩১ হাজার। আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৬ লাখ ৪০ হাজার। আর ৫ জুলাই পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় মৃত্যর সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার। আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ২৯ লাখ ৩৫ হাজার। ৩ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রে ৫৪ হাজার করোনায় আক্রান্ত সনাক্ত করা হয়েছে। ওই দিন পর্যন্ত এটি যুক্তরাষ্ট্রে সর্বোচ্চ সংখ্যক আক্রান্তের ঘটনা।

স্পেন, ইতালিসহ ইউরোপের অনেক দেশ স্বল্প সময়ে করোনার সবচেয়ে খারাপ অবস্থা পার করেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে চার মাসের মাথায় এখনো রেকর্ড আক্রান্তের ঘটনা ঘটছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে মাস্ক পড়ার প্রস্তাব দেওয়ায় মহামারি আইনে অভিযোগ এনে এক কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। ছবি : ফেসবুক
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে মাস্ক পড়ার অনুরোধ করায় মহামারি আইনে অভিযোগ এনে এক কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। ছবি : ফেসবুক

 

ট্রাম্প যখন লকডাউন তুলে নেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করে আসছেন এপ্রিলের শুরু থেকে তখনই অনেক বিশেষজ্ঞ এর মারাত্মক পরিণতির কথা বলেছিলেন। আর বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্রে সেটাই ঘটেছে। সামনে আরো ভয়ঙ্কর বিপদের আশঙ্কা করছেন অনেকে। করোনা এখন দ্রæত ছড়িয়ে পড়ছে আমেরিকান গ্রাম পর্যায়ে। গোটা যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্র এখন যেন করোনা ভাইরাসের দখলে। আর এভাবে মরিয়া হয়ে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে দেয়ার ভ‚মিকা পালনের পর এখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মাস্ক পরার পক্ষে কথা বলা শুরু করেছেন। অথচ ট্রাম্প এক সময় উৎসাহিত করেছেন মাস্ক না পরার জন্য। মস্কা পরিধানকারীদের তার বিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

লকডাউন তুলে নেয়ার বিপক্ষে নন অনেক আমেরিকান। কিন্তু তাদের অভিযোগ হলো লকডাউন তুলে নেয়ার পর করোনা যাতে ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। কোন কোন ক্ষেত্র আগে খোলা উচিত, আর কোন কোন ক্ষেত্র পরে খোলা উচিত এ বিষয়ে কোনো সঠিক গাইড লাইন দেয়া হয়নি।

করোনাকে সমস্যা হিসাবে না দেখার প্রবনতার কারনে অনেক আমেরিকান এখনো এই সংক্রামক ব্যাধিকে কোনো ধরনের পাত্তা দিতে চাইছেন না। অনেকে এখনো মনে করেন করোনা একটি ভাওতাভাজি। আমেরিকার অর্থনীতি ধ্বংস করার জন্য আর আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্ব ধ্বংসের একটি ষড়যন্ত্র। তাদের অনেকে মনে করেন করোনা আছে এটা সত্য কিন্তু আক্রান্ত হলেও তারা বেচে থাকবেন। তারা মনে করেন মাস্ক পরা বা সামাজিক দূরত্ব মানার মধ্যে কোনো ফায়দা নেই। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হাজার হাজার মানুষ নিয়ে হোয়াইট হাউজের সামনে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করেছেন। এটি ছিলো একটি ইঙ্গিতপূর্ন অনুষ্টান যে তিনি করোনাকে আমলে নেবেন না। অথচ ওয়াশিংটনের গর্ভনর ছুটির দিনে এমন অনুষ্টানে না যাওয়ার আহবান জানিয়েছিলোন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হোয়াইট হাউজের সামনে জাকজমকপূর্ন উৎসবে মেতে ছিলেন।

অবস্থা এমন দাড়িয়েছে মাস্ক না পরা লোকদের ভয়ে অনেকে মাস্ক পরে বাইরে বেরুনের চাইতে ঘরে থাকা নিরাপদ মনে করছেন। ট্রাম্প সমর্থকরা করোনা নিয়ে সমাজে অনেকের মধ্যে ভীতি আর আতঙ্ক ছড়ানোর কাজ করছেন। ট্রাম্প সমর্থক ফক্স নিউজের এক জরিপে বলা হয়েছে ৬১ শতাংশ আমেরিকান মাস্ক পরিধানের পক্ষে। কিন্তু বিপুল সংখ্যক মানুষের মতামতকে উপেক্ষা করছেন প্রেসিডেন্ট।

বিশ্লেষকরা মনে করেন করোনাকালে যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরের রুপ বেড়িয়ে এসেছে। দেশটির আভ্যন্তরিন অনেক দুর্বলতা প্রকাশ হয়ে পড়ছে। রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা আর অকার্যকর নেতৃত্বের কারণে ধীরে ধীরে পরাশক্তির মর্যাদা হারিয়ে ফেলছে যুক্তরাষ্ট্র।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে