আশির দশকের শেষের দিকে একটি অর্থনীতি বিষয়ক পাক্ষিকের জন্য ‘চা’ নিয়ে প্রতিবেদন করতে সিলেট গিয়েছিলাম। সিলেট ও মৌলভীবাজারের অনেক জায়গায় ঘুরতে হয়েছিলো, সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম অনেকের। পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে স্থানীয় অনেকেই চা বাগানের মালিক হলেও সেই ব্রিটিশ আমলে মুসলমানদের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজন ছিলেন বাগানমালিক । মরহুম হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর পিতা আবদুর রশীদ চৌধুরী তাদেরই একজন। তিনি শুধু জমিদারই ছিলেন না, ছিলেন রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধি। তার পুত্র আমিনুর রশীদ চৌধুরী পিতার উত্তরাধীকার হিসেবে চা বাগানের সাথে যুক্ত হন। দীর্ঘকাল ধরে সুনামের সাথে তাদের চা বাগান ঐতিহ্য রক্ষা করে এসেছে।
আমিনুর রশীদ চৌধুরীর ইন্তেকালের পর এই চা বাগানের দেখভালের দায়িত্ব পড়ে তার পুত্র নুরুর রশীদ চৌধুরীর (হ্যারল্ড) ওপর। আশৈশব বিলাতে বাস করা নুরুর রশীদ চৌধুরী যখন বাগানের হাল ধরেন তখন আন্তর্জাতিক বাজারে চায়ের খানিকটা দুর্দিন চলছে। অনেক বাগানের শ্রমিকদের বেতন-মজুরি বকেয়া পড়ে যায়। সংকটে পড়ে রশীদ চৌধুরীর টি এস্টেটও। দীর্ঘ প্রবাস জীবন কাটিয়ে দেশে ফিরে সদ্য বাগানের হাল ধরা আমিনুর রশীদ চৌধুরীর পুত্র পড়ে যান দ্বিধাদ্বন্ধে। সব জানার পর তার মা তাকে বলেন, ‘বাগানের শ্রমিক কর্মচারীরা বংশ পরম্পরায় কাজ করছেন। সুদিনে তারা যেমন পাশে ছিলেন, দুর্দিনেও তারাই পাশে আছেন। এদেরকে তাই পরিবারের সদস্য মনে করতে হবে। যেকোনোভাবেই হোক না কেন তাদের মজুরী-বেতনের ব্যবস্থা করতে হবে।’
মায়ের এই নির্দেশ পালন করেছিলেন নুরুর রশীদ চৌধুরী। তাদের অন্য সম্পদ বিক্রি করে পাওনা পরিশোধ করেছিলেন শ্রমিক-কর্মচারীদের।
করোনাকালের দুঃসময়ে বেসরকারীখাতে বহু প্রতিষ্ঠানের আচরণ দেখে কেন জানি বহু বছর আগের সেই স্মৃতি মনে পড়ে গেল। এই বাংলাদেশে যারা আজ ধনে-মানে শীর্ষে , মাত্র দুই-তিন দশক আগেও তাদের খুব একটা চিনত না মানুষ। অনেকেই শুন্য থেকে আজ মহিরূহে পরিণত হয়েছেন। বলা হয়ে থাকে এসবই নাকি বেসরকারী খাতের পৃষ্ঠপোষকতার ফল। বেসরকারী খাত ছাড়া ব্যক্তির যেমন বিকাশ হয় না, তেমনি হয় না প্রতিষ্ঠানের। বেসরকারীখাত মানেই প্রতিযোগীতা। বেসরকারীখাত মানেই সৃজনশীলতা।
আমার এ আলোচনার উদ্দেশ্য বেসরকারীখাতের পর্যালোচনা নয়। করোনাকালের এই দুঃসময়ে বেসরকারীখাতের আচরণ কেমন তা শুধু একটু খতিয়ে দেখা। যারা শ্রমজীবি সাধারণ মানুষের শ্রমে-ঘামে তাদের বিত্ত গড়েছেন, যারা মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণির মেধা ও শ্রমে বিকশিত হয়েছেন, একটির পর একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছেন, তারা করোনার এই মহাদূর্যোগে তাদেরই প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক-কর্মচারী এমনকি কর্মকর্তাদের ছাঁটাই করছেন, বেতন কমিয়ে দিচ্ছেন। এমন আচরণকে কেউ বলছেন হৃদয়হীন, কেউ বা বলছেন নিষ্ঠুরতা
বাংলাদেশের তৈরী পোশাকশিল্প যা ‘গার্মেন্টস’ বলে পরিচিত- এখন সবচেয়ে বড় বেসরকারী খাত। অন্যসব শিল্পখাতে কমবেশি সরকারী বিনিয়োগ থাকলেও এই খাতটি সম্পূর্ণরূপে গড়ে উঠেছে বেসরকারী উদ্যোক্তাদের হাত ধরে। যদিও সরকারের নানা ধরণের পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে। নানা উত্থান-পতন ও অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা এই শিল্পখাত করোনাকালে যে দুর্যোগের মধ্যে পড়েছে তা অতীতে আর কখনো হয়নি। কিন্তু সঙ্কটের শুরুতেই যেভাবে গার্মেন্টস মালিকরা হাহাকার শুরু করেছেন তাতে তাদের শুধু দীনতাই প্রকাশ পায়নি, প্রকাশিত হয়েছে তাদের চরম স্বার্থপরতাও। অত্যন্ত শ্রমঘন এই শিল্পের কর্মীরা শুরু থেকেই চরম অনিশ্চয়তায় পড়ে উদ্বেগ-উত্কণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন। নানামুখী চাপে পড়ে পোশাক শিল্পের মালিকরা সাধারণ ছুটিকালে বেতন-বোনাস দিলেও এখন চলছে ব্যাপকহারে ছাঁটাই-বেতন কর্তন।
এই চিত্র এখন বেসরকারীখাতের অন্যান্য শিল্প ও ব্যবসার ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে। দেশের নামীদামি শিল্পগ্রুপে নিরবে ছাঁটাই বা বেতন কর্তন চলছে। কোনো ঘোষণা ছাড়াই মালিকরা কর্মীদের জানিয়ে দিচ্ছেন, হয় বিদেয় হও না হয় বেতন কম নাও।অথচ তাদের কর্মীরাই এতকাল শ্রম-ঘাম দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলি বাড়-বাড়ন্ত করেছেন।
শুধু শিল্পকারখানা বা ব্যবসা প্রতষ্ঠানই নয়, সেবাখাতের চিত্রও একইরকম করুণ। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে বেসরকারী বিনিয়োগ গত তিনদশকে বহুগুণ বেড়েছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গড়ে উঠেছে হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়গনস্টিক সেন্টার। যদিও এর মান ও ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি নিয়ে অভিযোগ বিস্তর। তা স্বত্বেও চিকিত্সাসেবা বিস্তৃত হওয়ায় এর ইতিবাচক দিকটিই মানুষ গ্রহণ করেছে। সরকারীখাতের ওপর চাপ কমায় সাধারণ মানুষ খানিকটা হলেও স্বস্তি পেয়েছে। কিন্তু করোনাকালে বেসরকারী স্বাস্থ্যসেবা রাতারাতি গুটিয়ে যাওয়ায় গোটা জাতি বিস্মিত। কোনোধরণের হুমকি-ধামকি বা চাপেও কোনো কাজ হয়নি।
করোনার এই সঙ্কটকালে স্বাস্থ্যখাতের দায়িত্বই সর্বাধিক। অথচ যে অভিজ্ঞতা এদেশের মানুষ অর্জন করলো তা একথায় নিষ্ঠুর। অন্য আর সবখাতের ব্যাপারে যে মনোভাবই থাকুক, করোনাকালের অভিজ্ঞতায় ভবিষ্যতে স্বাস্থ্যখাতে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করে এখাতের ওপর সরকারের শতভাগ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। কারণ এর সাথে জনগনের বাঁচা-মরার প্রশ্ন জড়িত।
আমাদের অর্থমন্ত্রী যেখানে বাজেট পেশকালে ঘোষণা দিয়েছেন, আগে জনগনের জন্য খরচ করবো, পরে চিন্তা করবো আয়ের। অনেকেই এর সমালোচনা করলেও এর স্পিরিটটাকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাতে হয়। অর্থমন্ত্রীকে বাজেট কাটছাঁট করতে হবে, হয়তো বিপুল অংকের ঋণও করতে হবে। কিন্তু সঙ্কটকালে তার মানসিক দৃঢ়তাকে প্রশংসা করতেই হবে।
আমাদের বেসরকারীখাত যদি আজ একইরকম দৃঢ়তার প্রকাশ ঘটাতে পারতো, তবে হয়তো দেশজুড়ে মানুষের কষ্ট অনেক কম হতো। হতাশা ও অনিশ্চয়তা অনেকাংশে হ্রাস পেত। কিভাবে সঙ্কট মোকাবেলা করা যায় এবং শ্রমিক কর্মচারীদের নিয়ে সাহসীকতার সাথে সঙ্কট সমাধান করা যায়, সে চিন্তা তারা করতে পারতেন। তারা তাদের বিলাসী খরচ কমিয়ে, অর্জিত সম্পদের কিছু অংশ এই সঙ্কটকালে প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যয় করতেন তাহলে হয়তো ছাঁটাই বা বেতন কমানোর চিন্তা করতে হতো না। কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য। করোনাকালে আমাদের বেসরকারীখাতের স্বার্থপরতা উত্কটভাবে প্রকাশ পেয়েছে। বড় বড় প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা আত্মত্যাগের পরিবর্তে পুঁজিবাদের শেখানো পথেই হাঁটছেন। জাতিকে তাই নতুন করে ভাবতে হবে। ভবিষ্যতের কথা ভেবে সিদ্ধান্তও নিতে হবে, বেসরকারীখাতের ওপর আমরা কতটা নির্ভরশীল হব।
আযম মীর : সাংবাদিক
বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে