যে কৌশলে এগুচ্ছে চীন-ভারত

কার্টুনটি করেছেন জ্যামস ফারগুসন - এফটি ডটকম

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ০৬ জুলাই ২০২০, ১০:২৫

হিমালয় অঞ্চলে কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ গালওয়ান উপত্যকায় চীন ও ভারতের মধ্যে সংঘাতের পর দু’পক্ষই সীমান্তে শক্তি বাড়িয়েছে। ভারতের ২৩ জন সেনা প্রান হারানোর পরও দিল্লি পিছু হটতে চাইছে না। অপরদিকে চীনও সেখানে সামরিক শক্তি বাড়িয়ে চলছে।

পূর্ব লাদাখের গালওয়ানে চীনা সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের পর দুই দেশের মেজর জেনারেল পর্যায়ে গত ১৫ জুন এক বৈঠক হয়। সেখানে ঠিক হয়েছিল প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বা এলএসির কাছে থাকা চীনা ছাউনি সরিয়ে নেওয়া হবে। বৈঠকে সেনা সংখ্যা কমানো এবং মুখোমুখি অবস্থান থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ভারতের অভিযোগ চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি এই সিদ্ধান্ত মানছে না।

ভারতের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গালওয়ানে সংঘর্ষে নিহত অন্তত ১৫ ভারতীয় সেনার মাথায় ভোঁতা অস্ত্রের প্রাণঘাতী আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। অর্থাৎ, পরিকল্পনা করেই হামলা চালিয়েছিল চীনা সেনারা। গালওয়ান উপত্যকা এলাকায় প্রায় ১৪ হাজর ফুট উচ্চতায় দুর্গম পাহাড়ি চূড়ায় দুই দেশের সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষের সময় তাপমাত্রা ছিল হিমাঙ্কের ৫৫ ডিগ্রি নিচে ।

সেই সংঘর্ষস্থলের অদূরে গালওয়ান নদীর তীরে চীনা ক্যাম্পের সংখ্যা গত এক সপ্তাহে আরও বেড়েছে বলে বিভিন্ন উপগ্রহ চিত্রে দেখা যাচ্ছে। গোগরার হট স্প্রিং এলাকা এবং প্যাংগং লেকের উত্তরে ফিঙ্গার পয়েন্ট ৮ থেকে ৪ পর্যন্ত কংক্রিটের বাঙ্কার গড়ে অবস্থান নিয়েছে চীনা সেনারা। ভারত অভিযোগ করেছে, দৌলত বেগ ওল্ডি বিমান ঘাঁটির দক্ষিণে দেপসাং উপত্যকায় এলএসি পেরিয়ে প্রায় দেড় কিলোমিটার ভেতরে ঢুকে এসে চীনা সেনারা ‘ওয়াই-জংশনে’ ক্যাম্প তৈরি করেছে। ফলে ভারতীয় বাহিনীর পেট্রোলিং পয়েণ্ট ১০ এবং ১৩-তে যাওয়া বন্ধ।

উপগ্রহ চিত্রে ধরা পড়েছে গালওয়ানের সংঘর্ষস্থলে নতুন করে সেনা ক্যাম্প তৈরি করেছে চীন। সেখানে মোতায়েন করা হয়েছে বুলডোজার। অন্যদিকে চীনা হামলার আশংকায় সেখানে যুদ্ধ বিমান মোতায়েন করেছে ভারত।

নতুন উপগ্রহ চিত্রে দেখা যাচ্ছে, গত মাসে যে জায়গায় কিছুই ছিল না সেখানে এখন দেখা যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ বাঙ্কার, তাঁবু এবং সামরিক সরঞ্জাম মজুত করার ইউনিট। নতুন এই ছবিগুলোতে তারিখ রয়েছে ২২ জুন। মাক্সার নামে মার্কিন মহাকাশ প্রযুক্তি সংস্থা এই ছবিগুলো তুলেছে। সীমান্তে গালওয়ান নদীর পাশে চীন এই স্থাপনাগুলো গড়ে তুলেছে বলে মনে করা হচ্ছে। জুন মাসের শুরুতে আকাশ থেকে তোলা ছবিতে সেগুলোর কোনো অস্তিত্ব ছিল না।

উপগ্রহ চিত্র বিশ্লেষণ করে ভারতের খ্যাতনামা প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক অজয় শুক্লা বলেছেন গালওয়ান উপত্যকায় এলএসিতে ভারতের অংশে দেড় কিলোমিটার ভেতরে একটি বড় চীনা শিবির দেখা যাচ্ছে।

ভারতের স্থানীয় সংবাদমাধ্যমও ভারতীয় সেনাবাহিনীকে উদ্বৃত করে বলছে ১৫ জুনের সংঘাত এবং তার আগে অনুষ্ঠিত দুই দেশের কমান্ডার পর্যায়ের বৈঠকের মাঝখানে কোন একটা সময়ে চীন এই স্থাপনা তৈরি করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিরোধপূর্ণ যে এলাকায় সংঘর্ষ হয়েছিল সেখানে মে মাসে তোলা স্যাটেলাইট ছবিতে এই স্থাপনাগুলো ছিল না। এদিকে সীমান্ত সংঘর্ষের পর তিব্বতে মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষক পাঠাচ্ছে চীন। মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষক পাঠানোর এই খবরটি চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোয় গত ২০ জুন প্রকাশ হয়েছে।

ভারতের আরও অভিযোগ চীন লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় হাজার হাজার সৈন্য পাঠিয়েছে। তাদের অভিযোগ চীন সেখানে ভারতের ৩৮ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা দখল করে রেখেছে।

এই সীমান্ত নিয়ে দুদেশের মধ্যে গত তিন দশক ধরে চলা বিরোধের বহু দফা আলোচনার পর এখনও সমাধান হয়নি। সীমান্ত বিরোধ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ ১৯৬২ সালে হয়েছে। যে যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয় মেনে নিতে হয় ভারতকে।

চীন ও ভারতের এই দ্বন্দ্ব সামরিক পরিসর ছাড়িয়ে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তি খাতেও বিস্তৃত হয়েছে। চীনের সঙ্গে বৃহৎ তিনটি অর্থনৈতিক চুক্তি বাতিল করেছে ভারত। এরপর টিকটক, উই-চ্যাটসহ ৫৯টি মোবাইল অ্যাপ নিষিদ্ধ করে ভারত সরকার। এসব অ্যাপের মাধ্যমে চীন তথ্য সংগ্রহ করে বলে অভিযোগ ভারতের।

ঐতিহাসিকভাবেই হিমালয় অঞ্চলভুক্ত গালওয়ান উপত্যকায় চিহ্নিত কোনো সীমান্ত নেই। ব্রিটিশরা যখন এ অঞ্চল ছেড়ে চলে যায়, তখন অন্যান্য অঞ্চলের ক্ষেত্রে সীমানা চিহ্নিতকরণ হলেও গালওয়ান উপত্যকার সীমানা চিহ্নিত হয়নি। চীন ও ভারত উভয়ই এ অঞ্চলটি তাদের বলে দাবি করে।

 

সেখানে কোনো জনবসতি নেই এবং সেখানে বসবাস করাও একরকম অসম্ভব। তবে এই জায়গার যথেষ্ট স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব রয়েছে।

পুরো লাদাখ অঞ্চল একসময় ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রায় ৬০ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের লাদাখের স্ট্র্যাটেজিক অবস্থানকে বিবেচনা করেই ভারত সরকার গত বছর সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন এনে লাদাখকে জম্মু ও কাশ্মীর থেকে আলাদা করে একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করে।

লাদাখের পূর্বে রয়েছে চীনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল তিব্বত, দক্ষিণে রয়েছে ভারতের হিমালয় রাজ্য, পশ্চিমে রয়েছে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল গিলগিট-বাল্টিস্তান, আর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে রয়েছে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশ। সিয়াচিন হিমবাহ ও চীনের আকসাই চীন এ অঞ্চলের মাঝেই অবস্থিত। এ লাদাখেই অবস্থিত কারগিল। কারগিলে ১৯৯৯ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয়।

গালওয়ান উপত্যকার সীমানা চিহ্নিতকরণ সংক্রান্ত ‘লাইন অফ কনট্রোলের’ পাশাপাশি ভারত ২৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সড়ক নির্মাণ শেষ করেছে। এ সড়কটি লাদাখের রাজধানী লেহ-এর সঙ্গে চীনা সীমান্তের কাছাকাছি দৌলতবেগ সামরিক বিমানঘাঁটিকে সংযুক্ত করেছে। এটি একটি দুর্গম এলাকা। আগে লেহ থেকে দৌলতবেগ সামরিক বিমানঘাঁটিতে পৌঁছাতে দু’দিন লাগত। এখন লাগে মাত্র ৬ ঘণ্টা।

ভারতীয় সমরনায়কদের কাছে দৌলতবেগ বিমানঘাঁটির গুরুত্ব অনেক বেশি। এখান থেকে চীন নিয়ন্ত্রিত আকসাই চীনের সীমান্ত মাত্র ৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। আকসাই চীনকে ভারত নিজের বলে দাবি করে। এখান থেকে সিয়াচেন গ্লেসিয়ারের দূরত্ব মাত্র ৮ কিলোমিটার। এ বিমানঘাঁটিতে ভারত অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান মোতায়েন করেছে। চীন কিংবা পাকিস্তানের সঙ্গে যে কোনো যুদ্ধে এ বিমানঘাঁটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করা হয়।

গালওয়ান উপত্যকার ভারত নিয়ন্ত্রিত এলাকায় দিল্লির কর্মকান্ডকে চীন নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসাবে দেখছে। তবে নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীন শুধু ভারতের একার সঙ্গে নয়, জাপান , তাইওয়ান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনামের সঙ্গেও বিরোধে লিপ্ত রয়েছে। এর এসবের মাধ্যমে চীন তার প্রধান প্রতিদ্ব›দ্বী যুক্তরাষ্ট্রকে কড়া বার্তা দিতে চাইছে।

বাস্তবতা হচ্ছে চীন তার দাবিকৃত অঞ্চলের সুরক্ষা ও স্বার্থ রক্ষার জন্য শক্তিপ্রয়োগে করছে না। এ অঞ্চলের অন্য যে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের তুলনায় চীনের সামরিক শক্তি দ্রুতগতিতে বাড়ছে বলে মনে করছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা।

শি জিনপিং চীনের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে চীন সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নের জোর দিয়েছে। এখন আকাশ ও নৌশক্তির পাশাপাশি সাইবারশক্তিতেও চীন ব্যাপক অগ্রসর হয়েছে। চীনে এ বছর জাতীয় বাজেটের আকার কমলেও সামরিক খাতে ব্যয় প্রায় ৭ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।

নৌশক্তিতে চীন এখন আমেরিকাকে ছাড়িয়ে গেছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, চীনের এখন আছে ৩৩৫টি রণতরী। বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের আছে ২৮৫টি। যুদ্ধ হলে ওয়েস্টার্ন প্যাসিফিকে চীন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় হুমকি।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে লক্ষ করছেন, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কর্তৃত্বকে কেন্দ্র করে এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হচ্ছে। এ অঞ্চল যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির অংশ। যুক্তরাষ্ট্র এক ধরনের ‘কনটেনমেন্ট পলিসি’ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ চীনকে ঘিরে ফেলা! এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে চীনকে ভেঙে ফেলা। স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্র সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে এ নীতি অবলম্বন করেছিল। এবং ১৯৯১ সালে এসে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভেঙে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল।

এরপর থেকে বিশ্ব রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে কর্তৃত্ব করছে। কিন্তু সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে চীনের উত্থান মার্কিন একক কর্তৃত্বের প্রতি এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। তাই চীনকে চাপে রাখা, চীনকে ঘিরে ফেলার একটি স্ট্র্যাটেজি যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারতকে নিয়ে একটি জোট গঠিত হয়েছে। গত বেশ ক’বছর ধরে এজোট ভারত মহাসাগরে নৌ-সামরিক মহড়ায় অংশ নিয়ে আসছে। এ জোট চীনের বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে একটি পক্ষ হিসেবে কাজ করতে পারে। এছাড়া ভারত অতি সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে একটি সামরিক চুক্তি করেছে। এই চুক্তি বলে প্রয়োজনে অস্ট্রেলিয়ার বিমানবাহিনী ভারতীয় বিমানঘাঁটি ব্যবহার করতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও ভারতের এমন ধরনের চুক্তি রয়েছে। এ ধরনের চুক্তিকে চীন নিঃসন্দেহে তার জন্য একটি হুমকি হিসেবে দেখছে।

চীনের সরকারি মুখপাত্র গ্লোবাল টাইমসে প্রকাাশিত এক প্রতিবেদনে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন ব্যাপক সামরিক উপস্থিতি সংঘর্ষের ঝুঁকি বৃদ্ধি করেছে বলে মন্তব্য করা হয়েছে। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কমান্ডের আওতায় রয়েছে ৩ লাখ ৭৫ হাজার সদস্যের বিশাল বহর। এছাড়া আরও ৮৫ হাজার সদস্য রয়েছে, যাদের প্রয়োজনে নিয়োজিত করা সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর ৬০ শতাংশ যুদ্ধজাহাজ এ অঞ্চলে টহল কাজে নিয়োজিত। এ কারনে চীনা চ্যালেঞ্জ সামলাতে এশিয়ায় সেনা বাড়াচ্ছে আমেরিকা।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে