ভাঙা নৌকায় ডাঙার স্বপ্ন এবং এক জেলেপাড়ার গল্প

সাগরের পানিতে এমনটাই হয়। যাদের ঘর নেই, ঠিকানা নেই। তাদেরকে দু’মুঠো খাবারের খোঁজে এমন নিরুদ্দেশ যাত্রা করতে হয় - আল জাজিরা

  • শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ
  • ০৬ জুলাই ২০২০, ০৯:৫৫

আকাশের নিচে খোলা সাগর। উথাল ঢেউ। মেঘ ভেঙে নামছিলো তুমুল বৃষ্টি। উপক’ল থেকে দূরে কিছু একটা দেখা যাচ্ছিলো। মনে হলো একটা ট্রলার, বিপদে পড়েছে। ঢেউয়ের ভাঁজে দুলছে।

ট্রলারটা দেখতে বড়সর, উপকূল থেকেই ঠাহর করতে পারছিলেন জেলেরা। তবে বৃষ্টি আর বাতাসের দাপট চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিলো। আরও একটু সময় অপেক্ষা করলেন তারা।

ট্রলারটা আরো কাছে এলো। এবার বুক ধুকধুক করে উঠলো উপকূলের জেলেদের। দেখলেন ট্রলারটা ভাঙাচোড়া। আর এই ভাঙাচোড়া নৌকার পেটে কাঁতরাচ্ছে একদল ভাঙাচোড়া মানুষ।

একদিকে তুমুল বৃষ্টি, কালো মেঘে ঢাকা দিন। তার ওপর দিকহারা কিছু মানুষের আকুতি!
এই আকুতি কি ফিরিয়ে দেওয়া যায়?

নাহ। খোলা সাগরে এদেরকে ঠেলে দেওয়া যায় না, ঠিক করলেন ইন্দোনেশিয়ার আচেহ দ্বীপের জেলেরা।
তারা ভাঙা ট্রলারের এই ভাঙা মানুষদের ডাঙায় নিয়ে আসতে চাইলেন। তৈরি করলেন নিজেদের নৌকা। তারপর দরিয়া থেকে টেনে আনতে শুরু করলেন একদল মানুষকে।

মানুষগুলো যায় যায় অবস্থা। বাচ্চারা ট্যাঁ-ট্যাঁ করছে। নারীদের আহাজারিতে সাগর ভারি হয়ে উঠছে। তবে নারী কিম্বা শিশু, কারো গলায় তেমন জোর নেই। সাগরের ঢেউয়ে দুলতে দুলতে এরা ক্লান্ত। পুরুষেরা হতাশ।

এখন এদের সবার দরকার কিছু খাবার। আর একটু ডাঙার উম। ইন্দোনেশিয়ার আচেহ দ্বীপের জেলেরা সেই ব্যবস্থাই করতে চাইলেন।

মাছ ধরে যাদের পেট চলে, তারা ওইদিন সাগর থেকে তুলে নিতে চাইলেন শ’খানেক ঘরহারা মানুষকে। এদের মধ্যে আছে ৩০টি শিশু। আর আছে গর্ভবতী নারীও।

ওইদিন জেলেরা এগিয়ে না গেলে হয়তো সাগর এদের ভাসিয়ে নিতো আরো গভীরে। তারপর ভাসতে হতো। এবং ভাসতেই হতো। শেষে এদের ভাগ্যে জুটতো সলিল সমাধি।

সাগরের পানিতে এমনটাই হয়। যাদের ঘর নেই, ঠিকানা নেই। তাদেরকে দু’মুঠো খাবারের খোঁজে এমন নিরুদ্দেশ যাত্রা করতে হয়। অথচ একদিন এদের সবই ছিলো।

এই শ’খানেক মানুষের পরিচয়, এরা রোহিঙ্গা। মিয়ানমারের আরাকানে ছিলো এদের বাস। এখনো আছে। তবে সেই বসতভিটায় এখন মিয়ানমারের সেনারা চড়ে বেড়ায়। এই সেনারাই তাড়িয়ে দিয়েছে রোহিঙ্গাদের।

তাতে কি কোনো মাশুল গুনতে হয়েছে মিয়ানমারকে?
না। রোহিঙ্গা তাড়ানোর সময় আন্তর্জাতিক মহলে কেবল কিছু হইচই হয়েছে। বড় বড় সংস্থাগুলো নিন্দাবাদ করেছে। কিন্তু তাদের ঘর ফিরিয়ে দিতে এগিয়ে যায়নি কেউ।

মানুষকে সাগরের জলে ভাসিয়ে দিতে চান না আচেহ দ্বীপের জেলেরা । ছবি : আল জাজিরার ভিডিও থেকে
মানুষকে সাগরের জলে ভাসিয়ে দিতে চান না আচেহ দ্বীপের জেলেরা । ছবি : আল জাজিরার ভিডিও থেকে

 

রোহিঙ্গারা পালিয়ে এসেছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশ সরকার তাদের আশ্রয় দিয়েছে শরণার্থী শিবিরে। কিন্তু এমন অনিশ্চিয়তা নিয়ে কতদিন বেঁচে থাকা যায়!

এ কারণেই সাগর পাড়ি দিতে চান অনেক রোহিঙ্গা। যেতে চান ইন্দোনেশিয়ায়। একটু ভালো খেয়েপড়ে থাকার আশায় নৌকা ভেড়াতে চান মালয়েশিয়ার মতো দেশে। কিন্তু ওই দেশগুলোও রোহিঙ্গাদের ভারে ভারি হয়ে আছে। তাই নতুন করে নৌকা ভিড়তে দিতে চায় না।

রোহিঙ্গাদের ভাঙাচোড়া এই নৌকাটিও হয়তো আচেহ দ্বীপে ভিড়তে পারতো না, যদি নিয়ম-কানুনের ঝামেলা উৎরাতে না পারতো।

জেলেপাড়ার নেতা মোহাম্মদ হাসান সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘এদেরকে ডাঙার কাছাকাছি এনে খাবার দেওয়া হয়। পোশাক দেওয়া হয়। একজনের অবস্থা গুরুতর ছিলো। তাকে পাঠানো হয় হাসপাতালে।’

হাসান জানান, রোহিঙ্গাদের যখন নিয়ে আসা হয়, তখন থেকেই তাদের থাকা ও খাওয়ার সব ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত হয়ে যায় জেলে পরিবারগুলো। ওই সময়ই এদেরকে জেলেগ্রামে নিয়ে যেতে চাইছিলেন তারা। কিন্তু বাধসাধে নিয়মের ঝামেলা।
প্রশাসন শুরু থেকেই এদেরকে ডাঙায় উঠতে দিতে চাইছিলো না। হর্তাকর্তারা বলছিলেন, এদের মাধ্যমে করোনার সংক্রমণ হতে পারে। তাই জেলেদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়ায় আসতে চাইছিলেন তারা। জেলেদের এক দাবি, রোহিঙ্গারা জেলেপাড়ায় তাদের সঙ্গেই থাকবে।

কিন্তু প্রশাসন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলো না। পরে নতুন একটি নৌকা দিয়ে উপক’লের কাছাকাছিই এদের রেখে দেওয়া হয়। আর তলে তলে সিদ্ধান্ত হয়, কিছু খাবার আর বেঁচে থাকার উপকরণ দিয়ে এই রোহিঙ্গাদের আবার ঠেলে দেওয়া হবে অনিশ্চিত দরিয়ার পিঠে।

সেনা কমান্ডার কর্নেল সুমিরাতিং বাকরো বলেন, ‘আমরা সিদ্ধান্ত নেই তাদের নৌকাকে পাহারা দিয়ে আন্তর্জাতিক জলসীমায় পৌঁছে দেয়ার’।

তিনি বলেন, ‘আমরা তাদের নৌকাটি মেরামত করে দেবো। সঙ্গে কিছু রসদ দেবো। পরে বিমান ও নৌবাহিনীর তত্ত¡াবধানে ইন্দোনেশিয়ার জলসীমা থেকে বের করে দেবো।’

স্থানীয় পুলিশ প্রধান একো হারট্যানটোও সংবাদমাধ্যমকে জানান অস্থায়ী কিছু শেল্টার দিয়ে আবার সাগরে ফেরত পাঠানোর ইচ্ছাই তাদের ছিলো।

কিন্তু প্রশাসনের এমন ইচ্ছা শুরু থেকেই আঁচ করতে পারছিলেন জেলেরা। তখন থেকেই জেলেপাড়াজুড়ে প্রতিবাদ চলছিলো। তাদের এক কথা, আমরা মানুষ। ওরাও মানুষ। মানুষ হয়ে অন্য মানুষকে কি করে আবার বিপদের মুখে ঠেলে দিই!

জেলেরা বলছিলো, ‘সরকার যদি না পারে, আমরাই এদের থাকার ব্যবস্থা করবো। আমরাই বানাবো এদের ঘর। আমাদের সঙ্গে মাছ ধরবে। আমাদের সঙ্গেই এরা খাবে।’

অন্যদিকে প্রশাসন বুঝানোর চেষ্টা করছিলো, এখন করোনাকাল। এই সময়ে বাড়তি সতর্কতার দরকার আছে। রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে জেলেপাড়ায় করোনা ছড়াতে পারে।’

কিন্তু জেলেদের জবাব, এরা যদি করোনায় আক্রান্ত হয়ে থাকে তাহলে তো সাগরে গিয়ে আরো বিপদের মুখে পড়বে। ওখানেই অযত্নে ওদের মৃত্যু হবে। তারচেয়ে ডাঙায় রেখে দিয়ে এদের চিকিৎসা করানো ভালো।

এবার প্রশাসন বুঝাতে চাইলো, এর মধ্যে অনেক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। এভাবে যদি চলতেই থাকে, তাহলে তো একটার পর একটা নৌকা আসবে। আর তাদেরকে ঘর-বাড়ি বেঁধে দিতে হবে।

এই আকুতি কি ফিরিয়ে দেওয়া যায়? ছবি : আল জাজিরার ভিডিও থেকে
এই আকুতি কি ফিরিয়ে দেওয়া যায়? ছবি : আল জাজিরার ভিডিও থেকে

 

জবাবে জেলেরা জানালেন, অতোশতো বুঝি না। রোহিঙ্গাদের সাগরে ফেরত পাঠানো চলবে না, এটাই ফাইনাল।
তীব্র প্রতিবাদের মুখে ২৫ জুন রোহিঙ্গাদের তীরে নামতে দেয় প্রশাসন। এরপর এদের ঠাঁই হয় জেলেপাড়ায়। সেখানেই রোহিঙ্গাদের দেখাশোনা করা হবে বলে জানিয়েছেন ওই পাড়ার জেলে হামদানি ইয়াকুব।

তিনি বলেন, ‘বিষয়টা মানবিক। অতিথির সমাদর করা আমাদের উত্তর আচেহ জেলে সমাজের ঐতিহ্য। আশা করছি আমাদের দেখভালে রোহিঙ্গারা ভালোই থাকবে।’

সাইফুল আমরি নামের আরেক জেলে বলেন, ‘সরকার না পারলে জেলেদের জন্য আমরাই যথেষ্ট। আমরাও মানুষ, ওরাও মানুষ। আমাদের বড় মন আছে।’

আরেক জেলে অ্যাপলিস কুয়ারি বলেন, ‘গর্ভবতী নারী ও শিশুদের অসহায়ভাবে সাগরে ভাসতে দেখে আমাদের ভালো লাগছিলো না। তাই মানবিক কারণে এদেরকে তুলে এনেছি।’

জেলেদের এই মানবিক কাজের খবর এখন ছড়িয়ে গেছে গোটা বিশ্বে। ডাকসাইটে গণমাধ্যমগুলো এ নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সেগুলো পড়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এই জেলেদের প্রশংসায় ভাসাচ্ছেন। তাদের মানবিকতার প্রশংসা করে বিবৃতি দিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যশনাল। সংস্থাটির ইন্দোনেশিয়ার নির্বাহী পরিচালক উসমান হামিদ এক বিবৃতিতে বলেন, ‘রোহিঙ্গা শরণার্থীদের এই আশ্রয় দেওয়া সংহতির নজির হয়ে থাকবে। এটি মানুষের মনে আশাবাদ জাগিয়েছে। এর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব আচেহ সমাজের। এরাই এই নারী ও শিশুদের জন্য ঝুঁকি নিয়ে মানবতার উদাহরণ তৈরি করেছে।’

মানুষের জন্য কাজ করা আর অতিথিদের সমাদর করা ওই এলাকার ঐতিহ্য, হোক সে অনাহুত অতিথি। এই ব্যাপারে কেবল উপকূলের ওই জেলেপাড়া নয়, গোটা আচেহ প্রদেশেরই সুনাম রয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার এই প্রদেশটি মূল ভূখন্ড থেকে একটু দূরে, সিঙ্গাপুর পেরিয়ে, মালয়েশিয়ার কাছাকাছি। খোলা সাগরে সুমাত্রা দ্বীপের উত্তরে আলাদা অস্তিত্ব নিয়ে ভেসে আছে দ্বীপটি। ইন্দোনেশিয়ার অন্যান্য প্রদেশ থেকে এর বৈশিষ্টও একটু ভিন্ন। ২০০১ সাল থেকে এই রাজ্যে চালু আছে ইসলামী আইন। এর বেশিরভাগ বাসিন্দাই ধার্মিক মুসলমান। বিশেষ করে সুনামীর পর ওই অঞ্চলের লোকেরা ধর্ম-কর্মে আরো বেশি মন দিয়েছেন। উপক’লের বাসিন্দা এইসব জেলেরা ভালো করেই জানে, সাগর যখন ফুঁসে উঠে তখন মানুষ কতোটা অসহায়।
সম্ভবত এ কারণেই কোনো মানুষকে সাগরের জলে ভাসিয়ে দিতে চান না আচেহ দ্বীপের জেলেরা।

অথচ জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা নিজেদের ভাসিয়ে দিচ্ছে দরিয়ায়। এই নিঠুর সাগরই এদের বেঁচে থাকার আশা জোগায়। রোহিঙ্গারা ভাবে, সাগর পাড়ি দিয়ে নিরাপদ ডাঙায় যেতে পারলে জুটবে জীবনের নিরাপত্তা।

কিন্তু সাগর বিমুখ হয়। দরিয়ায় ডুবিয়ে মারে রাষ্ট্রহীন এই মানুষদের। মালয়েশিয়ার এক কোস্টগার্ড কর্মকর্তা আল জাজিরাকে জানিয়েছেন, জুনের গোড়ার দিকে ল্যাংকাউয়ের রিসর্ট দ্বীপে একটি রোহিঙ্গা নৌকা আটক করেন তারা। ওই নৌকাটি চার মাস ভেসেছিলো সাগরে। ওই নৌকায় কয়েকজনের মৃত্যুও হয়েছে।

ওই লাশগুলো ডাঙায় ফিরিয়ে নেওয়ার সামর্থ্য ছিলো না জীবিতদের। ছুঁড়ে ফেলতে হয়েছে সাগরের বিষাদ পানিতে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে