করোনায় মৃত্যু লুকাচ্ছে বিভিন্ন দেশ

মহামারি সম্পর্কে জনগণকে অন্ধকারে রাখা হচ্ছে - আলবার্তো মিয়ের, সিএনএন

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ২৫ মে ২০২০, ০০:১৮

চীন সরকার করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা লুকিয়েছে বলে জোরালো অভিযোগ রয়েছে। আফ্রিকার দরিদ্রতম দেশ ইকুয়েডরে করোনায় মৃত মানুষের সারি পড়ে ছিল রাস্তা ও বাথরুমে। কে রাখে তাদের হিসাব? তবে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে গোপনীয়তা রক্ষা কিংবা লাশের হিসাব রাখায় অব্যবস্থাপনার চিত্র কিন্তু দেখা গেছে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতেও। জন-অসন্তোষ এড়াতে কোনো কোনো সরকার মৃতের সংখ্যা কমিয়ে দেখাচ্ছেন বলে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য পাওয়া গেছে। বিশ্বে করোনায় যত লোকের মৃত্যুর কথা বলা হচ্ছে প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়ে প্রায় ৭০ হাজার বেশি। নিউইয়র্ক টাইমস ও রয়টার্সের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আজ তুলে ধরব সেই অবিশ্বাস্য ও হৃদয়বিদারক কাহিনী।

মেক্সিকো সরকার করোনাভাইরাসে মৃত শত শত, সম্ভবত হাজার হাজার লাশের তথ্য গোপন করেছে। কর্মকর্তাদের গোপন নথিতে বলা হয়েছে, সরকার রাজধানী মেক্সিকো সিটিতে মৃতের যে হিসাব দিচ্ছে প্রকৃত সংখ্যা অন্তত তার তিনগুণ। মেক্সিকো সিটি কর্তৃপক্ষ সরকাকে সতর্ক করে দিয়েছে যে তারা যেন মৃতের সংখ্যা নিয়ে লুকোচুরি না খেলে। জনগণ যেন দেশটির বৃহত্তম এই শহরে এবং সার্বিকভাবে সারাদেশে মৃতের স্বচ্ছ হিসাব পায়।

তবে সরকার তাদের কথায় কান দিচ্ছে না। মেক্সিকো সিটির করোনা রোগীতে ঠাসা হাসপাতালগুলোর চিকিৎসকরা বলেছেন, মহামারি সম্পর্কে জনগণকে অন্ধকারে রাখা হচ্ছে। কিছু হাসপাতালের ফ্লোরেও শুয়ে আছেন করোনা রোগীরা। কারো জায়গা হয়েছে তোষকের ওপর। প্রবীণ লোকেরাও বেড পাচ্ছে না, বসিয়ে রাখা হচ্ছে চেয়ারে। অনেক রোগী এ হাসপাতাল থেকে ও হাসপাতালে ছুটে পথেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। রাজধানীর একটি হাসপাতালের ডাক্তার জিনওভাল্লা আভিলা বলেন, হাসপাতালে সারাক্ষণ রোগীদের মৃত্যু হচ্ছে অথচ বাইরে বেরিয়ে এসে যা আমরা বলছি তাতে মানুষে আসল চিত্র সম্পর্কে ধারণাও পায় না।

মেক্সিকো সিটিতে করোনায় ৭০০ রোগী মারা গেছে বলে সরকার দাবি করেছে। তবে নিউইয়র্ক টাইমসের অনুসন্ধানে জানা যায়, এ রোগে এ শহরে মারা গেছে অন্তত আড়াই হাজার মানুষ।

১২ কোটি মানুষের দেশটিতে এপ্রিলের প্রথম দিক পর্যন্ত ৩ হাজার মানুষ মারা গেছেন সরকারের দাবি। আর করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন আরও ২৫০জন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেখানে করোনা টেস্ট এতো কম লোকের করা হয়েছে যে দেশটিতে এ মহামরির আসল চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না।

করোনা ভাইরাসে ল্যাটিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিলে এখন ভীতিকর অবস্থা তৈরি হয়েছে। প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। ব্রাজিলের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল মানাউসেও করোনার মৃতের সংখ্যা সরকার ঘোষিত সংখ্যার চেয়ে তিনগুণ বেশি। রয়টার্সের অনুসন্ধানে এ তথ্য জানা গেছে।

ব্রাজিলের আমাজন অঞ্চলের রাজধানী মানাউসে চিকিৎসা সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। সেখানে হাসপাতালে করোনা রোগীরা বেড পাচ্ছে না। মৃতদের দেওয়া হচ্ছে গণকবর। সরকারি তথ্যে দেখা যায়, ব্রাজিলের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে মানাউসে মৃতের সংখ্যা প্রায় চারগুণ বেশি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেবে, এপ্রিল এ অঞ্চলে মারা গেছেন ৩৮৫ জন। তবে রয়টার্সের অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ সংখ্যা প্রকৃত মৃতের চেয়ে অনেক কম। এপ্রিলে সেখানে করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন ৯৯৯ জন। এতে মৃত্যুর মোট সংখ্যা দাড়ায় ১৩৮৪ জনে। অথচ গত বছরের এপ্রিলে এ অঞ্চলে মারা গেছে ২৪৯ জন।

ব্রাজিলের কট্টরপন্থী প্রেসিডেন্ট জেয়ার বলসোনারোকে করোনা মহামারির মোকাবিলায় সবচেয়ে বড় হুমকি বলে মন্তব্য করেছেন বিশখ্যাত মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেট। বলসোনারো এখনো করোনার হুমকিকে আমলে নিচ্ছেন না। অথচ তার দেশে এখন প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছেন ১০ হাজারের বেশি লোক আর একদিনে ৭৫১ জনের মৃত্যুও হয়েছে।

নিউইয়র্ক টাইমসের অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত মার্চ ও এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্সসহ ১৭টি দেশে করোনায় সরকার ঘোষিত সংখ্যার চেয়ে অন্তত ৬৩ হাজার বেশি লোক মারা গেছে।

এই সংখ্যা করোনায় মৃতের সংখ্যার সঙ্গে যোগ করা হলে প্রকৃত সংখ্যা অনেক বড় হয়ে যায়। এই দুই মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় অনেক বেশি লোক মারা গেছেন এসব দেশে। অনেক লোক হাসপাতালে ভর্তির সুযোগ পায়নি বলে তাদেরকে সরকারি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

যেমন ফ্রান্সের প্যারিসে সবচেয়ে ভয়াবহ ফ্লু সিজনের সময় যত লোক মারা যায় এবার মারা গেছে তার দ্বিগুণ মানুষ। নিউইয়র্কে মৃত্যু হয়েছে স্বাভাবিকের তুলনায় ছয়গুণ বেশি লোক। যুক্তরাষ্ট্রে করোনার উৎপত্তিস্থল এই নিউইয়র্ক। সেখানে সরকার ঘোষিত মৃতের সংখ্যার চেয়ে প্রকৃত প্রাণহানি আরও অন্তত ৪৩০০ বেশি।

কোনো মহামারির মাঝামাঝি মৃতের হারই সঠিক হয় না। সবক্ষেত্রেই সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে দেখিয়েছে, এমনটা নাও হতে পারে। তবে গবেষকরা বলছেন, যেসব মৃত্যু বাদ পড়েছে সেগুলো হিসেবে আনা হলে মহামারির আরও পূণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায়। অনেক দেশই শুধু কভিড-১৯ রোগে হাসপাতালে মৃত্যু হলেই সেটা সরকারি পরিসংখ্যানে স্থান পায়।

জার্মানির ম্যাঙ্ক প্ল্যাঙ্ক ইন্সটিটিউটের জনতত্ত¡বিদ টিম রাইফ বলেন, করোনা মহামারিতে দিনের হিসেব দিনে পাওয়া একেবারেই অসম্ভব। কারণ দিনের অনেক মৃত্যুই হয়তো তখনও নথিভুক্ত হয়নি।

তবে যেসব দেশ করোনা মোকাবিলায় ধীরে পদক্ষেপ নিয়েছে, সেখানে অঘোষিত মৃত্যুর সংখ্যাটা অনেক বেশি। যেমন ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় মার্চে করোনাভাইরাসে ৮৪ জন মারা গেছেন বলে সরকারি তথ্যে দেখা যাচ্ছে। তবে জাকার্তার কবরস্থানগুলোর তথ্যে দেখা যায়, এ সময় সেখানে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ১৬০০ বেশি লোক মারা গেছেন।

ইকুয়েডরে গত তিন বছরে মার্চ ও এপ্রিল যত মানুষ মারা গেছেন, এবার মৃত্যু হয়েছে তার চেয়ে ৯৯০০ বেশি লোক। ইকুয়েডর সরকার দেশটিতে করোনায় মৃতের যে সংখ্যা প্রকাশ করেছে তার চেয়ে এই সময়টাতে ১২ গুণ বেশি মানুষ মারা গেছে।

ইকুয়েডরের পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর গুয়ায়াকিলে করোনা ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা হু হু করে বেড়ে চলেছে। জনশূন্য রাস্তাঘাটে পড়ে রয়েছে মানুষের মরদেহ। কেউ এগিয়ে যাচ্ছে না লাশের দিকে।

দেশটির কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন স্থানে পড়ে থাকা এসব মরদেহ সংগ্রহ করছে। জনবহুল শহর গুয়ায়াকিলের হাসপাতালগুলোতে অসুস্থ রোগীদের জন্য কোনো শয্যা খালি নেই। মর্গ কিংবা কবরস্থানেও জায়গা হচ্ছে না।

সেখানকার অনেক বাসিন্দা জানিয়েছেন, মরদেহ রাস্তায় ফেলে রাখা ছাড়া তাদের কোনো উপায় নেই। হাসপাতালে জায়গা না পাওয়ায় অনেকে বিনা চিকিৎসায় বাড়িতেই মারা যাচ্ছেন। শহরটিতে ঠিক কতজন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন- তার কোনো সঠিক তথ্যও নেই।

দেশটির কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২৩ থেকে ৩০ মার্চের মধ্যে শহরটির বিভিন্ন বাড়ি থেকে ৩০০টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এপ্রিল মাসে শুধু গুয়ায়াকিল শহরেই আড়াই হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার লোকের মৃত্যু হতে পারে। এসব অতিরিক্ত মৃত্যুর কারণ খুজে দেখতে শুরু করেছেন গবেষকরা।

জনতত্ত্ববিদরা বলছেন, এতো তড়িঘড়ি এ মহামারিতে মৃত্যুর হার পাওয়া সম্ভব নয়। তবে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে সব দেশই মৃত্যুর পরিসংখ্যান দ্রুত প্রকাশ করছে। ফলে অনেক মৃত্যুর তথ্যই তারা হয়তো যথাসময়ে পায় না। জাতিসংঘের জনতত্ত¡বিদ প্যাট্রিক গারল্যান্ড বলেন, এই পর্যায়ে মৃত্যুর যে হিসাব পাওয়া যাচ্ছে তা আংশিক। এতে মূলত হাসপাতাল ব্যবস্থার মৃত্যুর হিসেবে দেওয়া হয়। ভবিষ্যতে এই পরিসংখ্যান সম্ভবত বদলে যাবে। আগামী কয়েক মাসের স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যাবে।

ইউরোপের দেশগুলোরও একই চিত্র। গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইউরোপিয়ান মর্টালিটি মনিটরিং প্রজেক্টের মতে, এ মহাদেশের বিভিন্ন দেশ করোনায় মৃত্যুর যে প্রাথমিক হিসাব দিচ্ছে তাও স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ভিন্নতর। ইতালিতে গত পাচ বছরের তুলনায় গত মার্চে ৫০ শতাংশ বেশি লোকের মৃত্যু হয়েছে। স্বাভাবিক সময়ে এক মাসে দেশটিতে যত লোকের মৃত্যু হয়, গত মার্চে মারা গেছেন তার চেয়ে ২৫ হাজার বেশি লোক। ৎ

বেলজিয়াম ও ফ্রান্সের মত দেশে কর্তৃপক্ষ এখন হাসপাতালের বাইরে কভিড-১৯ রোগে মৃত্যুর সংখ্যা নির্ধারণ করার চেষ্টা করছে। কোনো সংখ্যা পেলেই তারা আগের তালিকার সঙ্গে তার সমন্বয় করে নিচ্ছেন। আবার ব্রিটেনে ডেথ সার্টিফিকেট ইস্যুর আগে তা তালিকাভুক্ত করা হয় না। এই প্রক্রিয়ায় পরিসংখ্যান পেতে বিলম্ব হলেও তা হয় নির্ভুল।

আবার নরওয়ে ও ডেনমার্কের মত ইউরোপের কিছু দেশে এবার মৃত্যুর হার বাড়ার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। এর কারণ, সেখানে করোনা ভয়াবহ হয়নি। এসব দেশ করোনার বিস্তার রোধে আগেভাগেই ব্যবস্থা গ্রহণ করে। যেমন ডেনমার্কে একজনও মারা যাওয়ার আগেই গত ১১ মার্চ সারাদেশে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। নওরয়ের তার পরদিনই লকডাউন করা হয়।

আবার সুইডেন লকডাউনের দিকে যায়নি। ফলে করোনাভাইরাসে ডেনমার্ক ও নরওয়ের চেয়ে অনেক বেশি লোক মারা গেছে সুইডেনে।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে