কেমন হবে এবারের ঈদ

করোনার মধ্যে ঈদ - সংগ্রহ

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ২৪ মে ২০২০, ২৩:৫৯

সারা বিশ্বের মুসলমানদের প্রধান দু'টি বাৎসরিক উৎসব হলো দুই ঈদ। এর একটি হলো ঈদুল ফিতর, যা পবিত্র রমজানে এক মাস সিয়াম সাধনার পরেই আসে এবং এ উৎসব এখন বলতে গেলে আমাদের দ্বারপ্রান্তে। তাই মনে প্রশ্ন জাগছে, কেমন হবে এবারের ঈদ?

প্রশ্নটির জবাব খোঁজার আগে মনে করতে চাই, অনাদিকাল থেকেই রমজানের ক'দিন যেতে-না-যেতেই মুসলিম দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে ঈদের খুশির আমেজ। আমাদের দেশও তার ব্যতিক্রম নয়। ঈদ মানে হলো রোজার সমাপ্তি। পবিত্র রমজান মাসে ঈমানদার মুসলিমমাত্রই পুরো মাস রোজা পালন করে থাকেন। দেন আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের কঠিন পরীক্ষা। সারাদিন বিরত থাকেন পানাহার থেকে, সবরকম অন্যায় ও অশ্লীল আচরণ ও চিন্তা থেকে। দিনের শেষে করেন ইফতার। ঘরে ঘরে তৈরি হয় বাহারী ইফতারসামগ্রী। হাটেবাজারেও বসে ইফতারী বিক্রির মেলা।

ইফতারের ঘণ্টাদেড়েক পরেই পাড়া-মহল্লার মসজিদ অভিমুখে ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের ঢল নামে। সবাই তখন ছোটে তারাবিহর নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্যে। বড়দের হাত ধরে এ সময় ছোটদেরও দেখা যায় তারাবিহর জামায়াতে শামিল হতে। তারাবিহশেষে দল বেঁধে গল্প করতে-করতে ঘরে ফেরে মুসল্লীরা। এও যেন এক সামাজিক সম্মিলনী।

রমজানের প্রথম সপ্তাহ পার না-হতেই মফস্বল শহর থেকে মহানগরের বিপণী বিতান - সবগুলো মেতে ওঠে আলোকসজ্জার উৎসবে। শুরু হয় বাহারী নামের সব পোশাকের বিজ্ঞাপন। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের পোশাকে ভরে যায় বিপণীকেন্দ্রগুলো। সমাজের সব শ্রেণীর মানুষ, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত নারী ও পুরুষ সেসব পোশাকের বাহার দেখতে ভিড় জমায় মার্কেটে, দোকানে। প্রথম দিকে তারা দেখে বেশি, কেনে কম। অপেক্ষায় থাকে আরো ভালো কিছুর এবং খানিকটা হলেও কম দামে পাওয়ার। ঈদ যতই এগিয়ে আসে ততোই লোকে লোকারণ্য হয়ে যায় সব বিপণীকেন্দ্র। এমনকি ফুটপাথের বিক্রেতাদেরও শ্বাস ফেলার সময় থাকে না। গরীব-দুঃখী মানুষের ভিড় যে সেখানে!

ঈদের দিনপনেরো আগে থেকেই বড় বড় নগরগুলোতে ট্রাফিক জ্যামের মচ্ছব শুরু হয়। বিশেষ করে রাজধানীতে রাজপথ বা ফুটপাথ - কোথাও দিয়ে চলাচলের তিল পরিমাণ জায়গা থাকে না। রাজধানী পরিণত হয় ট্র্যাফিক জ্যামের নগরে। হবে না-ই বা কেন! গোটা দেশই তখন ঈদের কেনাকাটা করার জন্য ঘর ছেড়ে নেমে এসেছে পথে!

এরই মধ্যে আবার অসংখ্য মানুষ ছুটে চলে গাঁয়ের পথে। সারা বছর ইট-কাঠ-পাথরের নগরীতে আবদ্ধ থেকে ঈদের ছুটিতে তারা ছুটতে চায় ফেলে আসা জন্মভূমির দিকে, বুকভরে টেনে নিতে চায় প্রকৃতির মুক্ত হাওয়া। কিন্তু ঈদের ছুটিতে নগরবাসের মতো গ্রামে যাত্রাও কঠিন হয়ে ওঠে। ট্রেন-বাস-লঞ্চ কোথাও টিকেটের দেখা মিলে না। এরই মাঝে টিকেট পাওয়া মানে যেন সোনার হরিণের দেখা পাওয়া।

অবশেষে একদিন রমজান মাস শেষ হয়। আসে ঈদ; খুশির ঈদ। ঘরে ঘরে ঈদের রান্নার ধুম পড়ে যায়। কতো বিচিত্র সেসব রান্না! ঈদের নামাজশেষে ঈদ্গাহ থেকে ফিরে চলে এবাড়ি-ওবাড়ি বেড়ানোর পালা। ছোটরা বড়দের সালাম করে পায় নগদ টাকা সালামী। প্রতিটি বাড়ি ব্যস্ত থাকে অতিথি আপ্যায়নে। চলে গল্প, হাসি, আড্ডার তুফান।

প্রশ্ন হলো, এবারের ঈদ কি সেই চিরায়ত ঈদের মতোই উৎসবমুখর হবে?

না, হবে না। হানাদার করোনা ভাইরাসের প্রবল আক্রমণে সারা বিশ্বে এখন চলছে লকডাউন। এ লকডাউনের কবলে পড়ে বিশ্বের কোটি মানুষ এখন গৃহবন্দী। মুসলিম বিশ্বও এর বাইরে নয়। তাই তো পবিত্র মক্কা-মদিনায় পর্যন্ত এখনও কারফিউ চলছে। উমরাহ বন্ধ, হজ অনিশ্চিত। তাই মুসলিম দুনিয়ায় এমন ভাবনা ছড়িয়ে পড়েছে যে, এবারের ঈদ অন্যান্য বারের মতো হবে না।

এ ভাবনা একেবারে অমূলক নয়, বরং সম্পূর্ণ বাস্তব। লকডাউনের কারণে এখন পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে ছোট-বড় সব রকম বিপণী বন্ধ রয়েছে। বলতে গেলে, বিশ্ব অর্থনীতির চাকাই এখন আর সচল নেই। মুসলিম বিশ্বে ঈদের কেনাকাটাও তাই বন্ধ। আমাদের দেশেও তা-ই। মফস্বল শহর থেকে শুরু করে রাজধানী পর্যন্ত কোথাও কোথাও কোনো বিপণী খোলা নেই। গত বছরও এমন দিনে যে বিপণীতে, এমনকি ফুটপাথেও পা ফেলাই মুশকিল হতো, এবার সেখানে বিরাজ করছে কবরের নির্জনতা। কবি-র ভাষায়, ''ঊর্ধে শূন্য/ নিম্নে শূন্য/ শূন্য চারিধার''। এমন দিগন্তপ্লাবী শূন্যতার মধ্যে কি ঈদ হয়, উৎসব হয়?

করোনা সংক্রমণের আশঙ্কায় এবার মসজিদে নামাজ আদায়ও বন্ধ রয়েছে। ফলে দৈনন্দিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পাশাপাশি জুমআ এবং তারাবিহর নামাজ আদায়ও বন্ধ রয়েছে। কারণ একটাই - লোকসমাগমের সুযোগ দেয়া হলে সামাজিক দূরত্ব বজায় নিয়মটি আর ধরে রাখা সম্ভব হবে না।

এ কারণে যেসব দেশ করোনা মোকাবিলায় তুলনামূলকভাবে সফলও হয়েছে, তারাও ঝুঁকি নিতে নারাজ এবং তাই এখন পর্যন্ত জনসমাগমের অনুমতি দিতে দ্বিধাগ্রস্ত। আমাদের বাংলাদেশে ঈদের সর্ববৃহৎ জামায়াতটি হয় কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায়। ইতিমধ্যেই আমরা জেনে গেছি, এবার শোলাকিয়ায় ঈদের জামায়াত হচ্ছে না। রাজধানী এবং দেশের প্রধান নগরীগুলোর ঈদ জামায়াতের কী হবে, সে সিদ্ধান্তটি এখনও আসেনি। তবে মনে হয়, বাংলাদেশও মুসলিম বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেই সিদ্ধান্ত নেবে।

তা-ই যদি হয়, তবে কেমন হবে এবারের ঈদ? দৃশ্যটি ভাবতেই অবাক লাগছে - ঈদ্গাহে দুই মিটার দূরে দূরে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করলেন একদল মুসল্লি। একটি জামায়াত শেষ হতেই দ্বিতীয়, তৃতীয়, এরকম বেশ-কয়েকটি জামায়াত অনুষ্ঠিত হলো। কিন্তু প্রতিটি জামায়াতশেষে অন্যান্য বারের মতো হাসিমুখে মোসাফাহ বা হাত মেলানো নেই, কোলাকুলি নেই। কেবল নির্ধারিত দূরত্ব থেকে বিষণ্ণ মৃদু হাসি বিনিময়, তারপর মুসল্লীরা অনেকটা মাথা নিচু করে যে যার বাড়ির পথ ধরলেন। প্রতিবার প্রায়-প্রত্যেক মুসল্লীর সঙ্গে থাকে শিশু-কিশোরের দল। এবার তারা একেবারে উধাও! প্রতিবার মুসল্লিরা ঈদের নামাজ শেষে কাছাকাছি কোনো আত্মীয়-বন্ধুর বাড়ি থাকলে সেখান হয়ে তারপর নিজ বাড়িতে যেতেন। এবার ব্যতিক্রম। এবার সবাই সোজা বাড়ির পথ ধরবেন।

প্রিয় দর্শক, এটি একটি কাল্পনিক চিত্র। কিন্তু করোনার দানবীয় থাবায় আমাদের স্বাভাবিক জীবন যেমন ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে, তাতে আসন্ন ঈদের দিনের ছবিটি এমন হয় কি না, এমন আশঙ্কায় প্রতিটি মানুষ আজ কম্পমান। আর তেমন কিছু হলে তা কেবল বাংলাদেশেই হবে, এমন নয়। ঘটবে সারা মুসলিম বিশ্বে।
তবে করোনার কারণে মানুষ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বাধ্য হলেও প্রযুক্তির সুবিধা ব্যবহার করে অনেকে প্রিয়জনকে ভার্চুয়ালি কাছে পেতে চাইবেন। এ ক্ষেত্রে টেলিফোন, ফেসবুক ইত্যাদি হবে তাদের সহায়ক। শারীরিকভাবে কাছাকাছি হতে না-পারলেও প্রযুক্তির পাখায় চড়ে প্রিয়জনকে কাছে পাওয়ার সুযোগটা নেবে করোনাতাড়িত বিশ্বের মুসলিম জনগোষ্ঠী। অনেক হতাশার মাঝে এবার সান্ত্বনা এটুকুই।