জাস্টিন ট্রুডো : মুসলমানদের কাছে কেন জনপ্রিয়

জাস্টিন ট্রুডো - ডিজাইন করেছে গার্ডিয়ান

  • আলফাজ আনাম
  • ২৪ মে ২০২০, ০০:২৯

প্রতিবছর ঈদ ও রমজানে একটি দেশের সরকার প্রধানের শুভেচ্ছা সারা বিশ্বের মুসলমানদের আলোড়িত করে। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো তিনি একজন অমুসলিম প্রধানমন্ত্রী। যিনি শুধু নিজ দেশে নন গোটা বিশ্বে সমান জনপ্রিয়। তিনি হচ্ছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। মানবতাবাদী ও ক্যারশমাটিক রাজনীতিক হিসাবে আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক ইস্যুতে ৪৯ বছর বয়সী এই রাজনীতিক কথা বলছেন অনেকটা স্রোতের বিপরীতে। জলবায়ু পরিবর্তন , শরণার্থী সমস্যা থেকে ইসলামোফোবিয়ার মতো বিষয়ে তার অবস্থান অত্যন্ত স্পষ্ট।

এবারের রমজান ও ঈদ এসেছে অনেকটা বিষন্নতরা মধ্যদিয়ে। করেনা ভাইরাসের মহামারীতে মানুষ অনেকটা ঘরবন্দী। বিপুল সংখ্যক মানুষ কর্মহীন অসহায় হয়ে পড়েছে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো রমজানের শুরুতে একটি ভিডিও বার্তায় সে দিকটি তুলে ধরেন। এই ভিডিও বার্তাটি দেখেছেন কয়েক মিলিয়ন মানুষ। মন্তব্য এসেছে লাখ লাখ।

মুসলমানদের উদ্দেশ্য জাস্টিন টুডো বলেন, ‘আসসালামু আলাইকুম। কানাডা ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলিমরা আজ থেকে রোজা রাখা শুরু করছেন। মাসজুড়ে মানুষ ইবাদত করবে। সারাদিন রোজা শেষে সন্ধ্যায় তা ভঙ্গ করবে।' এসময় রমজান উপলক্ষে মুসলমানদের প্রতি ইসলামের মূল্যবোধ অনুযায়ী যথযাথ সম্মান প্রদর্শনের আহ্বান জানান তিনি।

ট্রুডো বলেন, “নিঃসন্দেহে এবছরের রজমান হবে সম্পূর্ণ আলাদা।” তিনি বলেন, “কানাডার মুসলমানরা সবসময়ই আমাদের এই দেশকে অপেক্ষাকৃত ভালো ও শক্তিশালী জায়গা হিসেবে গড়ে তুলতে অবদান রাখছে এবং এই মাসেও এর ব্যতিক্রম হবে না।”

ট্রুডো বলেন, “আমি স্বীকৃতি দিতে চাই সেই সব গুরুত্বপূর্ণ কর্মীদের যারা রোজা রেখেও আমাদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। তারা তাদের কাজ করে যাচ্ছে এবং আমাদের সবার নিজেদের কাজ করে যাওয়া প্রয়োজন।” “সুতরাং এবছর বাসায় থেকে রোজা পালন করুন। মসজিদ বা কমিউনিটি সেন্টারে বন্ধুদের সাথে ইফতার না করে তাদের সাথে অনলাইনে যুক্ত হন,”। “কেনাকাটার জন্য সপ্তাহে একবার বাইরে যান। এবং যদি বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হয় তাহলে অন্তত দুই মিটার দূরত্ব বজায় রাখুন। এবারের রমজান স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ভিন্ন হবে। ভিডিওতে তার স্ত্রী সোফিয়া এবং পরিবারের পক্ষ থেকে সবাইকে শান্তিপূর্ণ রমজান পালনের শুভেচ্ছা জানান তিনি।

একটি নির্বাচনী প্রচারে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। ছবি : জেনিফার, রয়টার্স
একটি নির্বাচনী প্রচারে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। ছবি : জেনিফার, রয়টার্স

 

জাস্টিন ট্রুডো শুধু রমজানে এমন শুভেচ্ছা জানিয়ে থাকেন এমন নয়। তিনি কানাডার মুসলমানদের স্বাধীনভাবে ধর্ম পালনের নিশ্চয়তা দিয়েছেন। পশ্চিমা বিশ্বে ইসলামোফোবিয়া যখন তুঙ্গে তখন কানাডার মুসলমানরা অনেকটা নিরাপদে ধর্মপালন করতে পারেন। কানাডার কুইবেক সিটিতে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে মুসলমানদের একটি মসজিদে হামলার ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর দেওয়া এক বিবৃতিতে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেন, ‘আমরা ধর্মীয় স্থানে মুসলমানদের ওপর এমন সন্ত্রাসী হামলার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।’ মুসলমানরা কানাডার জাতি গঠন প্রক্রিয়ায় সঙ্গে যুক্ত। ‘আমাদের দেশ, আমাদের শহর আর আমাদের স¤প্রদায়ে নির্বোধ সন্ত্রাসী কর্মকার্ন্ডের কোনও স্থান নেই। কানাডার প্রধানমন্ত্রী ইসলামের মুল্যবোধগুলো চমৎকারভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেন।

কানাডার প্রধানমন্ত্রী ঈদ উল আজহার সময় একটি ভিডিও বার্তার মাধ্যমে মুসলমানদের শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। সেখানে তিনি ত্যাগ ও কল্যানের কথা তুলে ধরেন। কানাডার প্রধানমন্ত্রী বলেন। আসসালামু আলাইকুম। আজ কানাডাসহ বিশ্বের বেশ কতোগুলো দেশের মুসলমানরা পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপন করছেন। অনেকে হজ পালন করেছেন। সবাইকে শুভেচ্ছা জানাই। ঈদ মোবারক!

ট্রুডো বলেন, ঈদ হলো সবার মধ্যে শান্তি ও সমবেদনা জাগানোর একটি বড় সুযোগ। সারা বছরের কষ্ট-বেদনা ভুলে এ উৎসবে এসে সবাই মিলিত হন। একে অপরের মধ্যে দুঃখ-কষ্ট এবং আনন্দ শেয়ার করা হয়। ভালোবাসা বিনিময় হয়। সবাই মিলে আনন্দে মেতে উঠেন। সবার মধ্যে ঈদুল আজহার আনন্দ এবং শান্তি ছড়িয়ে পড়–ক। সমৃদ্ধি আসুক কানাডাসহ বিশ্বের সব মুসলমানের হৃদয়ে। ঈদ কাটুক আনন্দে।

এবারে করোনা ভাইরাসের মধ্যে কানাডার মুসলমানদের জন্য আরেকটি আনন্দের বার্তা ছিলো দেশটির বিভিন্ন মসজিদে আজান দেয়ার অনুমতি দেয়া হয়। হ্যামিলটন, টরোন্টো, এডমন্টন এবং অটোয়ার বিভিন্ন মসজিদে আজান দিয়ে জুমার নামাজসহ ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের অনুমতি দেয়া হয়। রমজানে মুসলমানদের বিভিন্ন ধরনের সামাজিক কর্মকার্ন্ডেও উৎসাহ প্রদান করেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী।

বিশ্বজুড়ে শরণর্থী সমস্যা, অভিবাসীদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারনা ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাব নিয়ে ধনী দেশের রাষ্ট্র প্রধানরা যখন নিশ্চুপ কিংবা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নীতিকে নীরব সমর্থন দিযে যাচ্ছে, সেখানে ট্রুডো সম্পুর্ন বিপরীত অবস্থান নিয়ে দুনিয়ার মানুষের দৃষ্টি আকর্ষন করেছেন। আসুন জেনে নেই ট্রুডোর এসব বিষয়ে অবস্থান সর্ম্পকে কিছু তথ্য

কানাডায় অভিবাসী ও শরণার্থীদের স্বাগত জানিয়ে বিশ^জুড়ে প্রশংসা কুড়িয়েছেন জাস্টিন ট্রুডো। ২০২১ সালের মধ্যে সাড়ে ৩ লাখ শরনার্থী গ্রহন করতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে। সিরিয়ায় শরনার্থী সমস্যা শুরু হওয়ার পর টুইটারে জাস্টিন ট্রুডো লিখেছেন ‘ধর্মবিশ্বাস যা-ই হোক না কেন নির্যাতন, সন্ত্রাস ও যুদ্ধপীড়িত অঞ্চল থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীরা কানাডায় স্বাগতম। বৈচিত্র্য আমাদের শক্তি।’

শরনার্থীদের উদ্দেশ্য বলেন ‘আপনাদের জন্য কানাডার দরজা খোলা’। তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহনের চার মাসের মধ্যে ২৫ হাজার শরণার্থীকে কানাডায় প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়। এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে। এ বছর শরনার্থীর সংখ্যা ৩ লাখ ৩০ হাজারে দাড়াতে পারে। জাস্টিন ট্রুডোর সরকারের মানবিক নীতি শুধু কানাডা নয়, বিশ্বজুড়ে তাকে একজন মহানুভব সরকার প্রধান হিসেবে পরিচিত করেছে। কানাডার তরুণ এই প্রধানমন্ত্রী সব সময় দেশটির সংখ্যালঘু মুসলমানদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। নিজে বিমানবন্দরে গিয়ে শরণার্থীদের স্বাগত জানিয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন কয়েকটি মুসলিম দেশের নাগরিকদের ওপর ভ্রমন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। তখন ট্রডো ঘোষণা দেন যেসব শরনার্থী যুক্তরাষ্ট্রে প্রবশে করতে পারবে না তাদের কানাডা স্বাগত জানাবে।

শুধু শরণর্থী সমস্যা নয় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে ধনী দেশগুলোর অবস্থানের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন জাস্টিন ট্রুডো। সুইডিশ কিশোরী জলবায়ু আন্দোলনকর্মী গ্রেটা থানবার্গের পাশে দাড়িয়েছেন ট্রুডো। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় রাজনীতিবিদদের ভূমিকা নিতে বাধ্য করতে এক বছর আগে সুইডেনের স্কুলশিক্ষার্থী গ্রেটা থানবার্গ শুরু করেন তরুণদের আন্দোলন। এর অংশ হিসাবে কানাডার মন্ট্রিল জলবায়ু পরিবর্তনবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেন ট্রুডো। নির্বাচনে বিজয়ের যে ভাষন দিয়েছেন সেখানেও তিনি জলবায়ু পরিবর্তন ও শরনার্থীদের আশ্রয় দেয়ার ব্যাপারে তার অবস্থান পুর্নব্যক্ত করেছেন। মুলত জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে অবস্থান, জলবায়ু পরিবর্তনের পদক্ষেপ নেয়ার ব্যাপারে জোরালো কণ্ঠ এবং সামাজিক নানা বিষয়ে অভিবাসনের পক্ষে প্রগতিশীল চিন্তা তাকে মর্যাদার আসনে বসিয়েছে।

জাস্টিন ট্রুডো বেড়ে উঠেছেন রাজনৈতিক পরিবেশে। কারন তার বাবা ছিলেন রাজনীতিক। ১৯৭১ সালে তার যখন জন্ম হয় তখন তার বাবা পিয়েরে ট্রুডো কানাডার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। বাবা মারা যাওয়ার পর তিনি যে বক্তব্য দিয়েছিলেন সেখানে তার রাজনৈতিক প্রতিভার দিকটি ফুটে উঠে।

জাস্টিন পিয়েরে জেমস ট্রুডো কানাডীয় রাজনীতিবিদ। জন্ম ২৫শে ডিসেম্বর,১৯৭১ সালে। তিনি কানাডার লিবারেল পাটির নেতা হিসেবে ২০১৫ সালে দেশটির ২৩ তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন। জো ক্লার্কের পর তিনি কানাডার দ্বিতীয় কম বয়স্ক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার পিতা পিয়েরে ট্রুডোও কানাডার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ফলে রাজনীতি তার রক্তের মধ্যে প্রবাহমান।

কানাডার অটোয়াতে জন্ম নেয়া ট্রুডো কলেজ জিন-দ্যে-ব্রেবুফ এ পড়ালেখা করেন। ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৪ সালে এবং ১৯৯৮ সালে ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়া থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। গ্রাজুয়েশন শেষ করে ট্রুডো ভ্যানকুভারের ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় ইউনিভার্সিটির শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

২০০৩ সালে চাকরি ছাড়র আগে তিনি মন্ট্রিলের ইকোল পলিটেকনিক থেকে এক বছরের ইঞ্জিনিয়ারিং প্রোগ্রাম শেষ করেন। ২০০৫ সালে জাস্টিন ট্রুডো ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশগত ভূগোলে স্নাতকোত্তর শুরু করলেও এক বছর পরেই তা থেকে অব্যাহতি নেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ইঞ্জিনিয়ার ও পরিবেশ বিষয়ে লেখাপড়ার কারনে অন্য রাজনীতিবিদদের চেয়ে ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহন করতে পারেন।

১৯৮৩ সালে বাবার মৃত্যুর আট বছর পর ১৯৯১ সালে জাস্টিন ট্রুডো রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন। ২০০৮ সালের ফেডারেল ইলেকশনে তিনি হাউজ অব কমন্সে নির্বাচিত হয়ে লিবারেল পার্টির যুব ও সংস্কৃতি বিভাগের দায়িত্ব পান। ২০১৩ সালের এপ্রিলে ট্রুডো লিবারেল পাটির নেতৃত্ব পান। অন্য সব প্রতিদ্ব›দ্বীদের চেয়ে সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে তিনি লিবারেল পার্টির জনপ্রিয় নেতা হিসেবে নিজেকে প্রমান করেন। ২০১৫ সালের ১৯ শে অক্টোবর দীর্ঘ নির্বাচনী প্রচারনার পর জাস্টিন ট্রুডোর নেতৃত্বে লিবারেল পার্টি ফেডালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। ২০১৯ সালের নির্বাচনে তার দল আবারো বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেন। দ্বিতীয় মেয়াদে বিজয়ী হওয়ার মধ্যদিয়ে ট্রুডো তার ক্যারশমাটিক নেতৃত্বের প্রমান রাখেন।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে