জিবুতিতে যুক্তরাষ্ট্র-চীন প্রতিযোগিতা

আফ্রিকা মহাদেশে আছে প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডার, বিপুল তরুণ জনগোষ্ঠী, অনেক খাতে বিনিয়োগের বিপুল সুযোগ - সিএনএন

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ১২ মে ২০২০, ০৫:৩৩

আজকের এ তথ্যপ্রযুক্তির যুগেও পাশ্চাত্যের অনেক দেশে এমন অনেক নাগরিক আছে, যারা জানেই না যে পৃথিবীতে বাংলাদেশ নামে একটি দেশ আছে। আবার কেউ-কেউ হয়তো নাম শুনেছে, তবে তাদের ধারণা, দেশটি জলে-জঙ্গলে ভরা একটি ভূখন্ড। বাঘ-ভালুকে ভরা। উন্নত মানের বাড়িঘর নেই, গাড়ি তো দেখেইনি কোনোদিন! লজ্জাজনক হলেও সত্য, আফ্রিকা মহাদেশ সম্বন্ধেও আমাদের দেশের অনেকের ধারণা প্রায়-এরকমই। আফ্রিকায় যুদ্ধ-সংঘাত, গোত্র প্রথা এবং সেই প্রথার নামে অনেক বর্বর নিয়ম-রীতি চালু আছে বটে, কিন্তু ওসবই 'সব' নয়। আফ্রিকা মহাদেশের অনেক উজ্জ্বল ও সম্ভাবনার দিকও আছে এবং আছে বলেই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এ মহাদেশটির গুরুত্ব প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে।

আফ্রিকা মহাদেশে আছে প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডার, বিপুল তরুণ জনগোষ্ঠী, অনেক খাতে বিনিয়োগের বিপুল সুযোগ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় আফ্রিকান দেশগুলোর ভোটাধিকার। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ১৯৪টি সদস্যরাষ্ট্রের মধ্যে ৫৪টিই আফ্রিকা মহাদেশের। এতেই বোঝা যায়, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের যে-কোনো সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা এ মহাদেশের দেশগুলোর আছে। এসব বৈশিষ্ট্যই আন্তর্জাতিক অঙ্গনের নেতৃস্থানীয় দেশগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

আরো একটি উদাহরণ দেয়া যাক। আফ্রিকা মহাদেশের প্রতি তিনটি দেশের একটিতে রয়েছে তেল ও গ্যাসের ভান্ডার। রয়েছে হীরা, সোনা, নিকেল, প্ল্যাটিনাম, ক্রোমিয়াম, ইউরেনিয়াম, কোল্টন প্রভৃতি মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদের খনি। আফ্রিকায় আবিষ্কৃত নতুন নতুন সম্পদ ও এর মজুদ দৃষ্টি কেড়েছে বিশ্বের। কারণ, বিশ্বে এসব সম্পদের পরিমাণ খুবই অল্প। এর ফল হয়েছে এই যে, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় সক্রিয় দেশগুলো এখন আফ্রিকা মহাদেশে তাদের প্রভাব বাড়াতে তৎপর হয়ে উঠেছে। এ তৎপরতা আফ্রিকা মহাদেশকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে নতুন এক বাস্তবতার সামনে।

বাস্তবতাটা হলো, একদিকে এর ফলে মহাদেশটির দেশগুলো অনেকগুলো বিদেশি রাষ্ট্রের সাথে ইন্টারঅ্যাক্ট বা আন্তঃসম্পর্ক গড়তে পারবে। ফলে কোনো একক দেশের পক্ষে আফ্রিকার ওপর আধিপত্য বিস্তার করা সম্ভব হবে না। আবার অন্যদিকে এ প্রতিযোগিতায় অনেকগুলো বিদেশী রাষ্ট্রের স্বার্থের সংঘাত জড়িত বলে তা আফ্রিকান দেশগুলোর ওপর বিরূপ প্রভাবও ফেলতে পারে।

এমন বাস্তবতায় আফ্রিকায় নিজেদের প্রভাব বাড়াতে নেমে পড়েছে অনেকগুলো দেশ। স্বাভাবিকভাবেই এই প্রতিযোগিতার সামনের সারিতে আছে আমেরিকা চীন। ওই মহাদেশটির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কেমন হবে, তা নির্ধারণ করার ক্ষমতা তো ওই দু' দেশেরই আছে। অতএব বলাই বাহুল্য যে, আফ্রিকাকে ঘিরে চীন-মার্কিন স্বার্থের সংঘাত আছে এবং থাকবে। সেটি কেমন। আসুন জেনে নেই

আফ্রিকার প্রতি চীনের আগ্রহ দেখেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও নতুন করে আগ্রহী হয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে, স্নায়ুযুদ্ধের সবচাইতে উত্তেজনাপূর্ণ দিনগুলোতে আফ্রিকার প্রতি ওয়াশিংটনের আগ্রহ ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ে। কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধ অবসানের পর আফ্রিকা ইস্যুকে তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্ব দিতে থাকে আমেরিকা। ৯/১১এর সন্ত্রাসী হামলার প্রতিক্রিয়ায় 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' ঘোষণা পর এবং আফ্রিকা মহাদেশে চীনের সক্রিয় উপস্থিতি দেখে আমেরিকা আবার আফ্রিকার প্রতি মনোযোগী হয়। কিন্তু ততদিনে চীন অনেক এগিয়ে গেছে, আফ্রিকায় তারা তখন বেশ প্রভাবশালী। এরই সূত্র ধরে ২০০০ সালে গঠিত হয় চায়না-আফ্রিকা কো-অপারেশন ফোরাম। ২০০৯ সালে আফ্রিকার বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার হওয়ার মধ্য দিয়ে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে দেয়।

আফ্রিকার সাথে দ্রূত সুসম্পর্ক গড়তে পারার পেছনে চীনের যে ফ্যাক্টরটি কাজ করেছে তা হলো, তারা যে-দেশটির সাথে সম্পর্ক গড়তে চায় তাকে পশ্চিমাদের মতো ওই দেশে 'গণতন্ত্র, জবাবদিহিতা, সুশাসন থাকতে হবে' ইত্যাদি পূর্বশর্ত দেয় না। ঠিক এ কারণেই চীনকে আকর্ষণীয় বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছে আফ্রিকার দেশগুলো। অন্যদিকে এর জন্য চীনকে সইতে হয়েছে সমালোচনা। বলা হয়েছে, চীন সুদানের ওমর আল বশিরের মতো স্বৈরাচারী আফ্রিকান শাসকদের প্রশয় দিচ্ছে। আফ্রিকা মহাদেশের আর্থ-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার হানি ঘটাচ্ছে।

অতএব জিবুতিতে চীন-মার্কিন একটা দ্বন্দ্ব যে অনিবার্য, তা না-বললেও চলে। ছবিটি কালচারাল এক্সপ্রেস এর
জিবুতিতে চীন-মার্কিন একটা দ্বন্দ্ব যে অনিবার্য, তা না-বললেও চলে। ছবিটি কালচারাল এক্সপ্রেস এর

 

ওই মহাদেশে চীনের উপস্থিতি ও কর্মকান্ডের সবচাইতে বড় সমালোচনাটি হলো, চীন আফ্রিকান দেশগুলোকে ঋণ দিতে-দিতে ঋণভারে জর্জরিত করে ফেলেছে এবং তাদেরকে ''ঋণের ফাঁদ কূটনীতির'' জালে আটকে ফেলে তাদের সব কৌশলগত স্থাপনা, যেমন সমুদ্রবন্দর, মিডিয়া চ্যানেল বিমানবন্দর ইত্যাদি দখল করে নিয়েছে।

আসুন এবার যাওয়া যাক জিবুতি-র দিকে। জিবুতি নামের ছোট্ট আফ্রিকান দেশটির নাম আমাদের দেশে খুব কম লোকেই জানে। হর্ন অব আফ্রিকা বা 'আফ্রিকার শৃঙ্গ' নামে পরিচিত অঞ্চলটির একেবারে শেষ প্রান্তে এর অবস্থান। আফ্রিকার সবচেয়ে ছোট দেশ এটি। কিন্তু দেশ ছোট হলেও এর গুরুত্ব অনেক বড়।

মধ্যপ্রাচ্যের সাথে দেশটির অবস্থানগত নৈকট্য, বিভিন্ন জ্বালানি পরিবহন সড়ক এবং বাব আল-মান্দেব প্রনালীর কাছাকাছি অবস্থান দেশটিকে বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর কাছে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। সবচাইতে বড় কথা হলো, মাত্র পাঁচ লাখ জনসংখ্যার এ দেশটি আজ এমন এক দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যে দেশে সামরিক ঘাঁটি করার জন্য আফ্রিকার বাইরের দেশগুলোও প্রতিযোগিতায় মেতেছে। তাই তো জিবুতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও চীন, ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, উগান্ডা, স্পেন ও সৌদি আরবের হয় সামরিক ঘাঁটি আছে, নতুবা সামরিক ঘাঁটি গড়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।

আফ্রিকার অন্যান্য দেশে বিদেশি সামরিক ঘাঁটি সন্দেহ ও প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিলেও জিবুতি-তে পরিস্থিতি কিন্তু ভিন্ন। ভূকৌশলগত অবস্থানের চমৎকার সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে বিদেশি সামরিক ঘাঁটিগুলো এখন ওই দেশের উপার্জনের একটা বিরাট উৎস হয়ে উঠেছে। এ খাত থেকে আয়কৃত অর্থের বেশিরভাগই দেশটি ব্যয় করে তার বন্দরগুলোর উন্নয়নে। এর ফলে বেড়ে যায় তাদের বাণিজ্য সক্ষমতা। জিবুতি-র রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও এর কৌশলগত আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হওয়ার একটি বড় কারণ হিসেবে কাজ করেছে। এভাবে, আমেরিকা ও চীনের মতো যেসব দেশ সারা বিশ্বে প্রভাব খাটাতে চায়, জিবুতিতে সক্রিয়ভাবে উপস্থিত থাকাটা তাদের পররাষ্ট্র নীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হয়ে উঠেছে।

অতএব জিবুতিতে চীন-মার্কিন একটা দ্বন্দ্ব যে অনিবার্য, তা না-বললেও চলে। আফ্রিকায় চীনের অপ্রতিরোধ্য উত্থান এবং এ উত্থানের প্রতিফল জিবুতিতেও পড়েছে। ২০১৬ সালের শেষ নাগাদ জিবুতি-র মোট ঋণের পরিমাণ ছিল জিডিপি-র ৫০ শতাংশ। ২০১৯ সাল শেষ হতে-না-হতেই আফ্রিকার এ ছোট ও দরিদ্র দেশটির মোট ঋণের পরিমাণ জিডিপি-র ১০০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। নিজেদের বন্দর উন্নয়ন এবং অন্যান্য খাতে বিনিয়োগের জন্য নেয়া এ ঋণের বড় অংশই এসেছে চীনের কাছ থেকে। চীন তার ''ঋণের ফাঁদ কূটনীতির'' মাধ্যমে এ ঋণ গছিয়ে দিয়েছে, যা পরিশোধ করা জিবুতি-র পক্ষে একরকম অসম্ভব।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে হেরিটেজ ফাউন্ডেশনে এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, চীনের এমন কর্মকান্ড আফ্রিকায় মার্কিন স্বার্থের প্রতি হুমকিস্বরূপ। কেননা, যে দেশে মার্কিন ঘাঁটি আছে সেরকম দেশের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব চলে যাচ্ছে চীন অথবা চীনের ঘনিষ্ঠ কোনো দেশের হাতে। এতে মার্কিন প্রশাসনের মর্যাদাহানি ও প্রভাব ক্ষুন্ন তো হচ্ছেই, জিবুতি এবং মধ্যপ্রাচ্যকে নিয়ে মার্কিন পরিকল্পনাও বিপন্ন হতে চলেছে।

জিবুতিতে প্রায় চার হাজার মার্কিন সৈন্য মোতায়েন রয়েছে। এমন অবস্থায় জিবুতি এবং গোটা আফ্রিকায় চীনের প্রভাব বিস্তার রোধ করাই ট্রাম্প প্রশাসনের আফ্রিকান স্ট্র্যাটেজির একটি প্রায়োরিটি বা অগ্রাধিকারমূলক কাজ। এ দৃষ্টিকোণ থেকেই আমেরিকা বরাবরই চীনকে এই বলে দোষারোপ করে আসছে যে, চীন আফ্রিকার নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার হানি ঘটিয়ে চলেছে।

এভাবেই ট্রাম্প প্রশাসনের 'অন্যকে ঠেকাও' নীতি এবং আফ্রিকায় চীন-মার্কিন প্রতিযোগিতার মাঝখান দিয়ে সন্দেহাতীতভাবে 'অতি গুরুত্বপূর্ণ' হয়ে উঠছে ক্ষুদ্র ও দরিদ্র দেশ জিবুতি। বিশে^র প্রভাবশালী দেশগুলোর নৌশক্তি প্রদর্শন কিংবা নৌ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য লোহিত সাগরের তীরের এই ছোট দেশটি হয়ে উঠেছে অতি আদরের। ২৩ হাজার ২শ বর্গ কিলোমিটারের এই দেশটিকে কেন্দ্র করে ভারত মহাসাগর, লোহিত সাগর ও এডেন উপসাগরের ওপর আধিপত্য বিস্তারের খেলা চলছে।

আজ এখানেই শেষ করছি। সমরাস্ত্র, প্রতিরক্ষা, কূটনীতি আর দেশ বিদেশের নানা তথ্য জানতে চোখ রাখুন বিডি ভিউজ ইনফোটেইনমেন্টে। চ্যানেলটি ভালো লাগলে সাবসক্রাইব করুন। আমাদের ওয়েব সাইট বিডি ভিউজ ডটনেট ভিজিট করুন।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন