ইসলামের পর এবার টার্গেট চীন

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে বিদ্রুপ করা একটি ছবি - রয়টার্স

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ১০ মে ২০২০, ০৩:৪৭

রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কিছু নেই, নেই চিরস্থায়ী শত্রূ বা বন্ধু বলতে কিছুও। এটা শুধু আমাদের দেশীয় রাজনীতির বেলায়ই নয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতির বেলায়ও সত্য। আর সত্য বলেই কথা উঠছে, করোনা দুর্যোগ কেটে গেলেই বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন করে শত্রূ-মিত্র নির্ধারিত হবে। এখন পর্যন্ত ইসলামকেই পশ্চিমা দুনিয়া তাদের শত্রূ হিসেবে ধরে রেখেছে এবং দুনিয়ার নানা প্রান্তে মুসলিমদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বরাজনীতির পর্যবেক্ষক ও ভাষ্যকাররা মনে করছেন এবং বলছেন, করোনা-পরবর্তীকালে ইসলাম নয়, চীনই হবে পাশ্চাত্য জগতের প্রধান শত্রূ। কেন আসুন জেনে নেই সেই বিশ্লেষণ।

নতুন এ ভাবধারার প্রধান হলেন ব্রিটেনের প্রখ্যাত সাংবাদিক পিটার ওবোরনে। তিনি ছিলেন বিখ্যাত ব্রিটিশ সংবাদপত্র দ্য টেলিগ্রাফ-এর চীফ পলিটিক্যাল কলামিস্ট। ২০১৩ সালে পেয়েছেন ব্রিটেনের সেরা কলামিস্ট সম্মাননা। পশ্চিমা মিডিয়ার একচোখা নীতিরও অনুসারী নন তিনি। রাজনৈতিক মিথ্যাচারের উত্থান, ইরানের পরমাণু পরীক্ষা নিয়ে পাশ্চাত্যের ভুল নীতি নিয়ে লেখা তাঁর একাধিক বই পড়লেই বোঝা যায়, কেমন ধারার মানুষ তিনি - অকপট, যুক্তিবাদী, সত্যান্বেষী। সেই মানুষটিই বলছেন, করোনা-পরবর্তীকালে বদলে যাবে বিশ্বরাজনীতির গতিপ্রকৃতি। তখন ইসলাম নয়, চীনই হবে পাশ্চাত্য জগতের প্রধান শত্রূ।

সাংবাদিক পিটার ওবোরনি । ছবিটি তার টুইটার একাউন্ট থেকে নেওয়া
সাংবাদিক পিটার ওবোরনে । ছবিটি তার টুইটার একাউন্ট থেকে নেওয়া

কেন ও কিভাবে তা ঘটবে, জানাতে গিয়ে সাংবাদিক পিটার ওবোরনে মনে করিয়ে দিয়েছেন মার্কিন রাজনীতিবিজ্ঞানী স্যামুয়েল হান্টিংটনের সেই বিতর্কিত ''ক্ল্যাস অব সিভিলাইজেশন'' তত্ত্বের কথা। আজ থেকে সিকি শতাব্দীরও বেশি সময় আগে দেয়া ওই তত্ত¡ই দুনিয়াজুড়ে একের পর এক যুদ্ধের ঘণ্টা বাজিয়ে দেয়, যে যুদ্ধ এখনও চলছেই।

হান্টিংটন যখন তার সেই বিতর্কিত রচনাটি লিখছেন তখন সবেমাত্র বার্লিন ওয়ালের পতন ঘটেছে আর অবসান ঘটেছে সোভিয়েত রাশিয়ার সাথে পশ্চিমা জগতের স্নায়ুযুদ্ধের। এমন সময় একটি শান্তিময় পৃথিবী গড়ার সম্ভাবনার পরিবর্তে হান্টিংটন আভাস দেন এক যুদ্ধের, যে যুদ্ধ হবে ইসলাম ও পাশ্চাত্যের মধ্যে। বলেন, এ দু' পক্ষের মধ্যে কখনোই আপস হওয়া সম্ভব নয়।

পিটার লিখেছেন, হান্টিংটনের সেই তত্ত্বের পর থেকেই 'মুসলিম' পরিচিতিটা সমসাময়িক রাজনীতির কেন্দ্রে এসে যায়। হান্টিংটন বলেন, ইসলাম হ্যাজ ব্লাডি বর্ডারস। ইসলামের সাথে অনেক যুদ্ধ হয়েছে, আরো হবে।হান্টিংটনের এ তত্ত¡কে একেবারে মাথায় পুরে নেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ ও ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের মতো পশ্চিমা রাজনীতিকরা। আর তারই ফল হিসেবে গত প্রায় সিকি শতাব্দী ধরে মুসলিম দেশগুলো একের পর এক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের আক্রমণের শিকার হয়েছে।

হান্টিংটনের এই তত্বের পাশাপাশি পশ্চিমা মিডিয়ায় মুসলিমদের চিত্রিত করা হয়েছে আইন অমান্যকারী, র‌্যাডিক্যাল আদর্শবাদী এবং পশ্চিমা দুনিয়ার প্রতি স্থায়ী হুমকি হিসেবে। বছরের পর বছর এ ক্লান্তিহীন প্রচারনার ফল হয়েছে এই যে, ইউরোপে জন্ম হয়েছে ভয়ঙ্কর ইসলামবিদ্বেষের এবং উদ্ভব ঘটেছে কট্টর ডানপন্থী অনেক রাজনৈতিক দলের।

সাংবাদিক পিটার ওবোরনে মনে করেন, করোনা দুর্যোগ কেটে যাওয়ার পরপরই এ চরম শত্রূতামূলক মনোভাবেরও অবসান ঘটবে। এটা ঘটবে এ কারণে যে, বিশেষ করে ব্রিটেনে করোনা দুর্যোগকালে মুসলিমদের ত্যাগ এতোই স্পষ্ট ও মহান যে, তা মুসলিমদের প্রতি জনগণের মনোভাবে ইতিবাচক পরিবর্তন আনায় সহায়ক হবে। করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্রিটেনে মৃত্যুবরণকারী প্রথম তিন চিকিৎসাকর্মীই মুসলিম।

এ ছাড়াও দ্বিতীয় একটি বিষয় কাজ করবে, তা হলো শত্রূ। পাশ্চাত্য জগত সবসময় একজন শত্রূ দেখতে পছন্দ করে। মনে হয়, তাদের একজন শত্রূ লাগেও। যুদ্ধ যাদের কাছে খেলা, চোখের সামনে তাদের তো একজন শত্রূ লাগেই। সেক্ষেত্রে তাদের লেটেস্ট টার্গেট হচ্ছে চীন।

পশ্চিমা দুনিয়া এখন চীনকে চিত্রিত করছে নতুন প্রকাশ্য শত্রূ হিসেবে, যেমনটি ২০ বছর আগে দেখাতো ইসলামকে। একই লোকেরা এ কাজ করে চলেছে - একই পত্রপত্রিকা, একই কলামিস্ট গোষ্ঠী, একই থিঙ্ক ট্যাঙ্কবহর, একই রাজনৈতিক দল ও গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ। ব্যতিক্রম শুধু একটাই। তা হলো, হান্টিংটন-নির্দেশিত র‌্যাডিক্যাল ইসলাম তথা মুসলিমদের পরিবর্তে এবার তারা নজর ফেলেছে দূর প্রাচ্যের প্রতি।

পৃথিবীর প্রধান মুসলিমবিরোধী ব্যক্তি, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন চীনকে আক্রমণ করতে শুরু করেছেন। যেভাবে তার রিপাবলিকান পূর্বসূরী বুশ আজ থেকে ২০ বছর আগে ইরাককে ''শয়তানের চক্র' বলে অভিহিত করেছিলেন। একইভাবে ট্রাম্পও ২০১৬ সালে তার নির্বাচনী প্রচারকালে বলেছিলেন, মার্কিন অর্থনীতিকে ''ধর্ষণ'' করে চলেছে চীন। করোনা দুর্যোগ শুরুর পর ট্রাম্পের আক্রমণের গতি ও মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। তিনি ক্রমাগত অভিযোগ করতে থাকেন যে চীন নিজ দেশে করোনা সংক্রমণ ও এতে মৃত্যুর সঠিক খবর প্রকাশ করছে না। এমনকি চলতি এপ্রিল মাসে তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে তহবিল দেয়াও বন্ধ করে দেন। সংস্থাটি নাকি অতিমাত্রায় চীনপ্রবন।

মুসলিমবিরোধী প্রপাগান্ডায় এক সময় সর্বশক্তি নিয়োগকারী ব্রিটিশ মিডিয়াকেও এবার চীনবিরোধী প্রচারনায় কোমর বেঁধে নেমে পড়তে দেখা যায়। ২০০৩ সালে ইরাক আগ্রাসনের ঢোল বাজিয়েছিল যে পত্রিকা, সেই 'দ্য সান' এবার একটি স্টোরি ছাপিয়েছে। এতে বলা হয়, করোনা ভাইরাস চীনই উদ্ভাবন করেছে। তারা প্রমান করতে' চেয়েছে যে, প্রানঘাতী রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তারা আমেরিকানদের চাইতে শ্রেষ্ঠতর। ইরাক আগ্রাসনের আগে ''দেশটিতে গণবিধ্বংসী অস্ত্র আছে'' মর্মে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের বিপজ্জনক প্রচারণায় এভাবেই সহায়তা দিয়েছিল ব্রিটিশ বৈদেশিকগোয়েন্দা সংস্থা এম আই সিক্্র। এবার একই রকম প্রচারনা লক্ষ্যস্থল হচ্ছে চীন।

বিবিসি-র টুডে প্রোগ্রামে গোয়েন্দা সংস্থা এম ১৬-এর সাবেক প্রধান স্যার জন সাওয়ার্স-এর সঙ্গে কথা বলছিলেন সাংবাদিক পিটার ওবোরন। তিনি বিস্মিত হন, যখন দেখেন সাবেক এ গোয়েন্দা প্রধান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে ট্রাম্পের তহবিল বন্ধ করে দেয়ার সমর্থক। ব্রিটেনের ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী ডমিনিক রাবের বক্তব্য আরো চমকপ্রদ। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, করোনা-উত্তর সময়ে চীনের সাথে আমাদের 'কাজকর্ম' আগের মতো থাকবে না, এ নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

কেন হঠাৎ পাশ্চাত্যের তোপের মুখে চীন? সাংবাদিক পিটার ওবোরন লিখেছেন, চীনের সমালোচনা করার ভালো-ভালো যুক্তি অবশ্যই আছে। করোনা ছড়িয়ে পড়ার শুরুর দিকে চীন বিষয়টি নিয়ে যে স্বচ্ছতার পরিচয় দেয়নি এবং আক্রান্ত ও মৃতের সঠিক সংখ্যাও প্রকাশ করেনি, এর যথেষ্ট প্রমান আছে। কিন্তু কথা হলো, ব্রিটেনসহ অন্য অনেক দেশই এ দোষে দোষী। অতএব বড় গলা করে চীনকে ক্রমাগত দোষারোপ করে যেতে না-পারলে নিজেদের অপরাধ আড়াল করা যাবে কী করে? সমালোচনার দিক বদল করে চীনকে নিয়ে মাতামাতির এটাই উলে­খযোগ্য কারণ। তাই তো যেসব নিও-কনজারভেটিভ থিংকট্যাংক বহু দিন ধরে ইসলামের বিরুদ্ধে বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছে, তাদেরও এখন দেখা যাচ্ছে চীনবিরোধী নতুন ভূমিকায়।

এ রকম একটি নিও-কনজারভেটিভ থিংকট্যাংক হলো দ্য হেনরি জ্যাকসন সোসাইটি বা এইচজেএস। এরা দীর্ঘদিন ধরে তাদের ভাষায় র‌্যাডিক্যাল ইসলাম বা ইসলামিজমের বিরুদ্ধে সমালোচনায় মুখর। হালে এরা নানা রকম খবর প্রকাশ এবং মিডিয়ায় সরাসরি হাজির হয়ে চীনকে আক্রমণ করে চলেছে। গত কয়েক মাস ধরে তাদের এ কাজ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এদের লেটেস্ট কাজটি হলো, একটি জনমত জরিপ। এতে দেখানো হয়েছে, ব্রিটেনের ৮০ ভাগেরও বেশি মানুষ চায়, করোনা ভাইরাস সংক্রমণের শুরুর দিকটা চীন কিভাবে মোকাবিলা করেছে, তা খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত অনুষ্ঠানের জন্য প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন চাপ প্রয়োগ করুন।

এখানেই শেষ নয়, দ্য হেনরি জ্যাকসন সোসাইটির সহযোগী ড. জন হেমিংস 'দ্য টেলিগ্রাফ' পত্রিকায় এক নিবন্ধে চীনের ক্রমবর্ধমান 'দুষ্ট' প্রভাবের বিষয়ে পাশ্চাত্যকে সতর্ক করে দিয়েছেন। একই সংস্থার এশিয়া স্টাডিজ সেন্টারের পরিচালক ম্যাথু হেন্ডারসন 'দ্য সান'-এর সাথে একযোগে 'হট টেকস' নামে একটি নতুন ভিডিও সিরিজ ছেড়েছেন। এর প্রথম এপিসোডে প্রশ্ন করা হয়েছে, ''করোনা ভাইরাস মহামারী কি চীনের চেরনোবিল?''

দ্য হেনরি জ্যাকসন সোসাইটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্রিটেনের উচিত করোনা মহামারীর জন্য সাড়ে তিন হাজার কোটি পাউন্ড ক্ষতিপূরণ চেয়ে চীনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের করা।
গেটস্টোন ইন্সটিটিউট নামে আরেকটি থিংকট্যাংক তথাকথিত র‌্যাডিক্যাল ইসলাম ও চীনের তুলনা করে বলেছে, করোনা মহামারী যেন পাশ্চাত্যের জন্য ''আরেকটি ৯/১১''। প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কি চীনই হতে যাচ্ছে পাশ্চাত্যের নতুন শত্রূ? কেউ-কেউ বলতে পারেন, হ্যাঁ। কেননা, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকেই তার জায়গায় কাউকে প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল পাশ্চাত্যের।

সাংবাদিক পিটার ওবোরন মনে করিয়ে দেন, হান্টিংটনের 'সভ্যতার দ্ব›দ্ব' তত্তে¡ কিন্তু শুধু ইসলামি সভ্যতার ব্যাপারেই হুঁশিয়ার করে দেয়া হয়নি, তিনি ইসলামের পাশাপাশি একটি দ্বিতীয় ''চ্যালেঞ্জার'' সভ্যতার ব্যাপারেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন। বলেছিলেন, চীনই হতে পারে পাশ্চাত্যের প্রতি সবচেয়ে শক্তিশালী ও দীর্ঘমেয়াদী হুমকি।

পিটার লিখেছেন, এসব পরিবর্তনই যে রাতারাতি ঘটবে, তা নয়। তবে তিনি মনে করেন, ইরান হোয়াইট হাউসের নজরে থাকবে, যেমন জোরদার হবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক।

সাংবাদিক পিটার ওবোরনের পর্যবেক্ষণ হলো, আমরা এখন হয়তো এমন একটি দীর্ঘ সময় অবসানের দিকে এগিয়ে চলেছি, যে সময়টায় ইসলামই ছিল 'বিভেদরেখা'। পশ্চিমা দুনিয়া নিজেই এখন নিজের জন্য নতুন একটি শত্রূ খুঁজে নিয়েছে। তা-ই যদি হয়, তাহলে বিশ্বের মুসলিমরা আরো একটু স্বস্তির সাথে নিশ্বাস নিতে পারবে।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন