বিশ্বনেতার আসন হারাচ্ছে আমেরিকা

কার্টুনটি এঁকেছেন গেজিইনুস - দ্য কার্টুন মুভমেন্ট

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ০৮ মে ২০২০, ২২:৪৫

একশ বছরের বেশি সময় ধরে বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বের যে কোনো বড় সংকটে সবার দৃষ্টি থাকত হোয়াইট হাউসের দিকে। শুধু বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক সংকটই নয়, অনেক সময় বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যায়ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে সেই দিন অতীত হতে চলেছে।

করোনা ভাইরাস মহামারিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক সংকটে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়া তো বহু দূরের কথা, অভ্যন্তরীন সংকটেই দেশটি এখন হাবুডুবু খাচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনা সংকটের জেরে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বের আসন হারাচ্ছে। ভবিষ্যতে তার জায়গা দখল করতে পারে এশিয়া। নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আজ আমরা সেই বিশ্লেষণ জানাবো।

আমেরিকার হাসপাতালগুলোর ওয়ার্ডে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের অস্বাভাবিক ভীড়ের ছবি আর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হওয়া বেকারত্বের সারি বিশ্বকে বিস্মিত করেছে। ঠিক একই সময় আটলান্টিকের অপর পাশের ইউরোপীয়রা বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ও ক্ষমতাধর দেশটির দিকে তাকাচ্ছে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে।

বার্লিনের পাবলিক পলিসি বা জননীতি বিষয়ক বিশ্ববিদ্যালয় হার্টি স্কুলের সভাপতি হেনরিক এন্ডারলেইন বলেন, নিউইয়র্ক শহরের এসব দৃশ দেখে লোকজন বলেছেন কিভাবে এটা ঘটতে পারে? কিভাবে এটা সম্ভব? আমরা স্তদ্ধ হয়ে গেছি। বেকারত্বের দিকে তাকান, ২ কোটি ২০ লাখ লোক কর্মহীন হয়ে পড়েছে।

এ মহামারি নয়াদিল্লি থেকে নিউইয়র্কের মানুষের জীবন ও জীবিকা কেড়ে নিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। আমেরিকার স্বাতন্ত্র্যবাদ সর্ম্পকে মৌলিক বিশ্বাসকেও ঝাঁকুনি দিয়েছে। আমেরিকার স্বাতন্ত্র্যবাদের অর্থ হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দশকের পর দশক ধরে আমেরিকা যে বিশেষ ভ‚মিকা পালন করে বিশ্বনেতা হয়েছে এবং বিশ্বের জন্য উদাহরণ তৈরি করেছে।

আমেরিকা আজও শীর্ষে আছে। সেটা ভিন্নভাবে। কভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যায় দেশটি এখন সবার ওপরে। আক্রান্ত হয়েছে ১০ লাখের বেশি মানুষ আর মারা গেছেন অর্ধ লক্ষাধিক।

এই মহামারিতে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রাজ্য গভর্নররা বিবাদে জড়িয়েছেন। ট্রাম্প বিজ্ঞানী উপদেষ্টাদের আবেদন উপেক্ষা করে লকডাউনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে সমর্থন দিয়েছেন। ভাইরাসটি এবং এর চিকিৎসা স¤ক্সর্কে প্রায় প্রতিদিনই ভুল তথ্য হাজির করেছেন। ভাইরাসকে অজুহাত হিসেবে কাজে লাগিয়ে তিনি অভিবাসনপ্রত্যাশীদের গ্রিনকার্ড স্থগিত করে দিয়েছেন।

প্যারিসের রাজনৈতিক বিজ্ঞানী ও জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ডমিনিক মইসি মনে করেন, পরিস্থিতি সামাল দিতে আমেরিকা এবার শুধু খারাপ করেনি, বরং অস্বাভাবিক রকমের খারাপ করেছে। এই মহামারি প্রতিটি দেশের শক্তিমত্তা ও দুর্বলতাগুলো উন্মোচন করেছে। যেমন চীন করেনার তথ্য গোপনের শক্তিমতা দেখিয়েছে। আবার এই মহামারিতে জার্মানির মূল্যবোধ, সম্মিলিত চেতনার প্রকাশ দেখা গেছে।

কার্টুনটি এঁকেছেন ইনগ্রাম পিন। প্রকাশ করেছে ফিন্যান্সিয়াল টাইমস
কার্টুনটি এঁকেছেন ইনগ্রাম পিন। প্রকাশ করেছে ফিন্যান্সিয়াল টাইমস

 

অনেক ইউরোপীয়দের চোখে এ মহামারিতে যুক্তরাষ্ট্রের দুটো বৃহৎ দুর্বলতা ধরা পড়েছে। একটি হলো ট্রাম্পের অস্থিরমনা নেতৃত্ব। তিনি বিশেষজ্ঞ এবং তার নিজের বিজ্ঞানী উপদেষ্টাদের মতামতকে অবমূল্যায়ন ও অস্বীকার করেছেন। তৃতীয়টি হলো আমেরিকায় শক্তিশালী জনস্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা জালের অনুপস্থিতি।

ডমিনিক মইসি বলেন, আমেরিকা ভুল যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছিল। আমেরিকা প্রস্তুতি নিয়েছিল আরেকটি নাইন ইলেভেন মোকাবিলার। তার পরিবর্তে চলে এসেছে একটি অদৃশ্য ভাইরাস। এতে এই প্রশ্ন উঠছে যে আমেরিকা কী ভুল অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ভুল ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে?

ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করেই আমেরিকা ফার্স্ট বা আমেরিকাই প্রথম নীতির বাস্তবায়ন শুরু করেন। ইউরোপীয়রা দেখেছেন যে তিনি তাদের সঙ্গে কয়েক দশকের মৈত্রীর বন্ধন রাখতে আর আগ্রহী নন।

আর্ন্তজাতিক চুক্তি থেকে একের পর এক সরে যাচ্ছেন । ট্রাম্প ন্যাটোকে বলেছেন সেকেলে, প্যারিস জলবায়ু চুক্তি এবং ইরানের পরমাণু চুক্তি বাতিল করেছেন। ফলে এক শতাব্দীর বেশি সময়ের মধ্যে এই প্রথম কোনো বৈশি^ক সংকটে কেউই আর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের দিকে তাকিয়ে নেই।

জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাইকো মাসও এমনটাই বলেছেন। তিনি মনে করেন, চীন এ সংকটে কর্তৃত্বাদী পদক্ষেপ নিয়েছে। আর আমেরিকা দীর্ঘদিন ধরে এ ভাইরাসকে গুরুত্ব দেয়নি। দুটোই চরম পদক্ষেপ যা ইউরোপের জন্য মডেল হতে পারে না।

শীতল যুদ্ধের অবসানের প্রায় তিন দশক পর আমেরিকার গল্প এখন ভিন্ন ধরনের। যে দেশটি ৭৫ বছর আগে ইউরোপে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটাতে সহায়তা করেছিল। পরবর্তী দশকগুলোতে গণতন্ত্রকে রক্ষা করেছিল সে দেশটি এখন নিজ নাগরিকদের সুরক্ষায় অনেক স্বৈরতান্ত্রিক অবস্থান নিয়েছে । গণতান্ত্রিক দেশের তুলনায় অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে। আমেরিকার সহযোগিতায় দ্রুত উন্নতির শিখরে পৌঁছা জার্মানি ও দক্ষিণ কোরিয়া করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় চমৎকার দৃষ্টান্ত রেখেছে। সমালোচকরা বলছেন, করোনা সংকটে আমেরিকা শুধু বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতেই ব্যর্থ হয়নি, বরং নিজ জনগণের পাশেও দাঁড়াতে পারেনি।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র শুধু বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতেই ব্যর্থ হয়নি, এ সংকটে সেদেশেই জাতীয় ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব চোখে পড়েনি। এক অর্থে এটা খোদ আমেরিকাতেই আমেরিকার নেতৃত্বের ব্যর্থতা। এটা সত্য যে ইউরোপের কিছু দেশে করোনা ভাইরাসে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে জনসংখ্যা অনুপাতে কভিড-১৯ রোগে বেশি মানুষ মারা গেছে ইতালি, স্পেন ও ফ্রান্সে। তবে এসব দেশে করোনার সংত্রক্রমণ শুরু হয়েছিল আগেভাগে এবং তারা প্রস্তুতির সময় পায়নি।

বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির পদক্ষেপে বৈপরীত্য ছিল বিশেষভাবে চোখে পড়ার মত। জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেলের সমালোচনা হচ্ছে এই কারণে যে তিনি এই সংকটে ইউরোপের নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেননি। তবে এ মহামারি মোকাবিলায় তিনি যেসব পদক্ষেপ নিয়েছেন তাকে পাঠ্যপুস্তকে তুলে ধরার মতো উদাহরণ বলে মনে করা হয়। শক্তিশালী জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার বদৌলতে জার্মানীর পক্ষে এই সাফল্য সম্ভব হয়েছে। তবে ব্যাপকহারে পরীক্ষা নিরীক্ষা ও তার পরীক্ষিত ও কার্যকর রাজনৈতিক নেতৃত্ব সংকট নিরসনে বড় ভূমিকা রেখেছ।

মার্কেল যা করেছেন ট্রাম্প তা পারেননি। ট্রাম্প ভোট হারানোর ঝুঁকি নিতে চাননি এবং ত্বত পদক্ষেপও নেননি। অন্যদিকে মার্কেল তার দেশের ১৬ গভর্নরের সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়েছেন। ট্রাম্প গভর্নরদের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়েছেন। একজন প্রশিক্ষিত পদার্থবিজ্ঞানী মার্কেল বিজ্ঞানীদের উপদেশ অনুসারে পদক্ষেপ নিয়েছেন। বিশে^র অন্যান্য দেশে যেসব প্রশংসনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে তা অনুসরণ করেছেন।

ফলে তার জনপ্রিয়তা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। অথচ কিছুদিন আগেও মার্কেলকে মনে করা হতো ক্ষয়িষ্ণু শক্তি। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন যে বর্তমান মেয়াদের পর তিনি আর ক্ষমতার জন্য লড়বেন না। আর এখন তার জনসমর্থন ৮০ ভাগে ঠেকেছে। আসলে মার্কেলের মনটা একজন বিজ্ঞানীর এবং তার হৃদয়টা এক যাজক কন্যার।

দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পুনরায় চালু করতে ট্রাম্প একটি প্যানেল গঠন করেছেন। সেখানে স্থান পেয়েছেন শুধু ব্যবসায়ীরা। মার্কেলও এ সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে সুপারিশ প্রণয়নের জন্য একটি বহুপাক্ষিক প্যানেল গঠন করেছেন। এতে রাখা হয়েছেন জার্মানির ন্যাশনাল একাডেমি অফ সায়েন্সের ২৬ শিক্ষাবিদ। প্যানেলে আরও আছেন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ, মনোবিজ্ঞানী, শিক্ষা বিশারদ, সমাজবিজ্ঞানী, দার্শনিক ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ। দুনেতার পার্থক্যটা স্পষ্ট।

জার্মান প্যানেলের প্রধান গেরাল্ড হগ বলেন, এই সংকটে দরকার সামগ্রিক সুপারিশ। আমাদের রাজনীতিকরা এখান থেকে সেটাই পাবেন। হক নিজেও নিউইয়র্কের কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির গবেষক ছিলেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে বিশে^র বহু সেরা বিজ্ঞানী। কিন্তু তাদের কথা শোনা হয় না। এটা একটা ট্রাজেডি।

ফরাসি গবেষক বেঞ্জামিন হাদিদ বলেন, এ মহামারি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের পরীক্ষা নিচ্ছে। তবে দীর্ঘমেয়াদে এতে দেশটির কতটা ক্ষতি হবে তা বলার সময় এখনো আসেনি। চীনের সঙ্গে কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে হয়তো দেশটির পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে শেষ পর্যন্ত জাতীয় ঐক্য তৈরি হতেও পারে।

নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ইতিহাসের গতিধারা বদলেও যেতে পারে। ১৯৩০ এর দশকের মহামন্দার জেরে আমেরিকার উত্থান ঘটেছিল। হয়তো করোনাভাইরাস যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের সামাজিক নিরাপত্তা জাল ও সহজে স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার উপযোগী জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। ইউরোপের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অনেক মানবিক। ফলে এই ব্যবস্থায় করোনাভাইরাসের মত মহামারির মোকাবিলায় ভালো প্রস্তুতি থাকে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে বর্বর পুঁজিবাদী ব্যবস্থা।

তবে অনেকে বিশ্লেষক মনে করেন বর্তমান সংকট ইতিহাসের গতি পরিবর্তন হিসেবে কাজ করতে পারে। এতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ উভয়ের প্রভাবই কমে যেতে পারে। ২০২১ সালের কোনো এক সময় করোনা সংকট থেকে বিশ্ব বেরিয়ে আসতে পারবে। এরপর একদিন আসবে ২০৩০ সাল। তখন বিশ্বে দেখা যাবে এশিয়ার আধিপত্য আর পাশ্চাত্যের ক্ষয়।

এই প্রতিবেদনের ভিডিও রুপ দেখতে ক্লিক করুন