মিয়ানমারে চীনের প্রেসিডেন্ট : বাংলাদেশের পাশে কে?

'শি জিন পিং' ও 'অং সান সু চি' - সংগৃহীত -

  • আলফাজ আনাম
  • ২৬ জানুয়ারি ২০২০, ১০:৪৬

মিয়ানমারের সবচেয়ে পুরানো ও ঘনিষ্ট মিত্র চীন। তাদের বন্ধন টিকে আছে ৭০ বছর ধরে। সামরিক শাসনে দুনিয়া থেকে যখন মিয়ানমার একটি বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রে পরিনত হয়েছিলো তখন মিয়ানমারের পাশে দাড়িয়েছিলো বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশ চীন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সব সময় মিয়ানমারের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে চীন। দীর্ঘ এ সময়ে মিয়ানমারে ক্ষমতার পালাবদল হলেও মিত্রতার সম্পর্কে এর প্রভাব পড়েনি। মিয়ানমার তার পুরানো বন্ধু চীনের পাশাপাশি ভারত ও জাপানকে পেয়েছে বন্ধু হিসাবে। কিন্তু মিয়ানমারের ওপর চীনের যে প্রভাব তা অন্য কোনো দেশের পক্ষে ছাপিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সম্প্রতি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তিন দিনের মিয়ানমার সফর করে গেলেন, মিয়ানমারে পৌঁছে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তার সফরকে দুই প্রতিবেশির মধ্যকার সম্পর্কের ‘ঐতিহাসিক মুহূর্ত’ বলে মন্তব্য করেন। মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর সুচি বলেন, ‘বিনা বাক্যব্যয়ে পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত প্রতিবেশি চীনের পাশে থাকবে মিয়ানমার। শিং জিনপিং তার সফরে দেশটির শীর্ষ সেনা কমকর্তাদের সাথে বৈঠক করেন। যার মধ্যে সেনা প্রধান মিংঅহ্ল্ইা আছেন। যার ওপর পশ্চিমা দেশগুলো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।


শি জিন পিং মিয়ানমার সফরের মুল লক্ষ ছিলো সামরিক ও অবকাঠামো খাতে চীনের প্রভাব অক্ষুন্ন রাখা। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন জাতিগোষ্টীর সাথে চীন সর্ম্পক বজায় রেখে চলে। ফলে মিয়ানমারের নীতি নির্ধারনে বাইরের শক্তি হিসাবে চীন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা পালন করে। দ্বিপাক্ষিক রাষ্ট্রীয় সর্ম্পক ছাড়াও সামরিক নেতৃত্বের সাথে চীনের রয়েছে বিশেষ সর্ম্পক।


চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মিয়ানমার সফরে উভয় দেশ ৩৩টি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। মিয়ানমারে বিপুল বিনিয়োগের অবকাঠামো প্রকল্পগুলো গতিশীল করতে এসব চুক্তি স্বাক্ষর করে। সেগুলো মূলত বেইজিংয়ের বেল্ট ও রোড উদ্যোগের সঙ্গে সম্পর্কিত। বিলিয়ন ডলার মূল্যের চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর বাস্তবায়নের সাথে সম্পৃক্ত। এসব চুক্তির মধ্যে রয়েছে চীন থেকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত রেল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা, সহিংসতা কবলিত রাখাইনে গভীর সমুদ্রবন্দর ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা।


চীনের প্রেসিডেন্টের এই সফরে সবচেয়ে গুরুত্ব পেয়েছে চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর ও গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মান প্রকল্পে। এই প্রকল্প গুলোর সাথে রয়েছে বাংলাদেশের গভীর সর্ম্পক। চীন ও মিয়ানমার কিয়াকপিউ বন্দর প্রকল্প নিয়ে অনেক আগে চুক্তি সই করেছে। এখন এই বন্দরের সাথে অবকাঠামো প্রকল্পগুলো এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। মিয়ানমারের রাখাইন স্টেটে এই গভীর এই সমুদ্রবন্দরটি থেকে ৭৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ তেল ও গ্যাস পাইপলাইনটির সাথে যুক্ত হবে চীন। এটি হবে চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর ও চীনের বৃহত্তর বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশবিশেষ। ভারত মহাসাগরের উপকূলের এই বন্দরটি মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা বড় তেল ট্যাঙ্কারগুলো ব্যবহার করতে পারবে এবং এটার সাথে চীনের মূল ভূমির তেল ও গ্যাস পাইপলাইন সংযোগ থাকবে। মালাক্কা প্রণালী দিয়ে যে নৌ রুট রয়েছে, এটাকে বেইজিং তার বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করছে, কারণ মালাক্কার উপর বহু দেশের প্রভাব রয়েছে।


মিয়ানমার রাখাইন প্রদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করেছে। এই প্রদেশকে ঘিরে রয়েছে অনেকগুলো প্রকল্প। রাখাইনে ভারত ও চীন উভয়ের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রকল্প রয়েছে। ভারত সিত্তুই বন্দর ব্যবহার করার জন্য মিয়ানমারের সাথে একটি চুক্তিতে সই করেছে। দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর জন্য এই বন্দরটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হচ্ছে। এই বন্দরের মাত্র ১০০ কিলোমিটার দূরে চীন একটি তেল ও গ্যাস পাইপ লাইন পরিচালনা করছে। এটি চীনা কুনমিং পর্যন্ত গেছে। ভারত ও চীন উভয় দেশ রাখানইন স্টেটকে থেকে রোহিঙ্গা উচ্ছেদে নীরব সমর্থন দিয়েছে বলে মনে করা হয়। যার বোঝা এখন বাংলাদেশকে বহন করতে হচ্ছে। অথচ এই বন্দর ও অর্থনৈতিক অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের সহজে কাজের সুযোগ তৈরি করা যেতো। মিয়ানমারের জাতিবিদ্বেষী কর্মকান্ডে পাশে থেকেছে এই দুদেশ।
সিত্তুই ছাড়াও মিয়ানমারের সাথে কালাদান মাল্টি মডেল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্টে সই করেছে ভারত। এর মাধ্যমে উত্তরপূর্ব ভারতের সাথে মিয়ানমারের সড়ক যোগযোগ স্থাপিত হবে এবং বঙ্গোপসাগরে আসার সুযোগ পাবে। অপরদিকে জাপান ইয়াঙ্গুন থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে স্পেশাল ইকোনমিক জোনের পাশে নতুন কন্টেইনার টার্মিনাল চালু করেছে। যেখানে বছরে ২লাখ ৪০ হাজার কন্টেইনার হ্যান্ডেলিং করতে পারবে। মূলত চীনের সাথে প্রতিযোগিতার অংশ হিসেবেই এই প্রকল্পগুলো নিচ্ছে জাপান।


অবকাঠামো প্রকল্প ছাড়াও মিয়ানমারের সাথে চীনের রয়েছে অস্ত্র বানিজ্যের দীর্ঘ সর্ম্পক। বলা যায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ভিত্তি গড়ে তুলেছে চীন। যদিও মিয়ানমারের সেনা নেতৃত্ব এখন রাশিয়া, ইসরাইল ও ভারতের কাছ থেকে সমরাস্ত্র কিনছে। তবে এখনও চীন দেশটির প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ। এর ফলে মিয়ানমারের সেনা নেতৃত্বের সাথে রয়েছে চীনের ঘনিষ্ট সর্ম্পক। আসুন দেখে নেই গত এক দশকে চীন কী ধরনের অস্ত্র সরবরাহ করেছে।
গত এক দশকের মধ্যে দেশটির কাছে দুটো জিঙ্ঘু-২ শ্রেণীর ফ্রিগেট, ৭৬টি টাইপ-৯২ সাঁজোয়া যান, ১২টি সিএএসসি সিএইচ-৪ মনুষ্যবিহীন আকাশযান বা ড্রোন এবং ১৬টির মতো সিএসি পিএসি জেএফ-১৭ জঙ্গি বিমান বিক্রি করেছে। যেগুলোর মূল্য প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার। এই সব অস্ত্রাদির বেশিরভাগ এরই মধ্যে সরবরাহ করা হয়ে গেছে। প্রথম চারটি জেএফ-১৭ বিমান মিয়ানমারের বিমানবাহিনী এরই মধ্যে বহরে যুক্ত করেছে। ১৯৯০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত মিয়ানমার সেনাবাহিনী সবচেয়ে বেশি যুদ্ধ বিমান কিনেছে চীনের কাছ থেকে। চীন থেকে ১২০টি যুদ্ধ বিমান কিনেছে মিয়ানমার।


ভূরাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতাকে মিয়ানমারের জেনারেলরা সাফল্যের সাথে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন। পশ্চিম বিশ^ মিয়ানমারের জেনারেলদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও কার্যকর কোনো ভুমিকা পালন করতে পারছে না। মুলত চীন এক্ষেত্রে কৌশলী ভুমিকা নিয়েছে। অংসান সূচিকে সামনে আনার পর পশ্চিমা বিশ^ আশা করেছিলো দেশটিতে প্রভাব বাড়বে। কিন্তু পরিস্থিতি সম্পুর্ন উল্টে গেছে। সূচি এখন সেনা নেতৃত্বের মুখপাত্রে পরিনত হয়েছেন। বেইজিং মিয়ানমারের আভ্যন্তরিন রাজনীতির রসায়নটা খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারে। সূকিকে সামনে রেখে সেনা নিয়ন্ত্রনের বেসমারিক খোলস থাকলেও মুল শক্তির সাথে চীনের ঘনিষ্টতা। এ কারনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আর্ন্তজাতিক ফোরামে যে কোনো প্রস্তাবের বিপক্ষে থাকে চীনের অবস্থান।


রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্টীর ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারনে আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায় থেকে মিয়ানমার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে বলে যে ধারনা করা হয়েছিলো তা ভুল প্রমানিত হচ্ছে। পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারের সমালোচনা করলেও দেশটির পেছনে এসে দাড়িয়েছে চীন, রাশিয়া ও ভারত। অর্থনৈতিক কারনে এই প্রতিযোগিতায় সামিল হয়েছে জাপান। মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি নিজে আর্ন্তজাতিক আদালতে সেনাবাহিনীর পক্ষে দাড়িয়েছেন।
জাতিসংঘসহ আর্ন্তজাতিক ফোরামে দীর্ঘদিন থেকে চীন মিয়ানমারের অবস্থানকে সমর্থন দিয়ে এসেছে। বলা যায় মিয়ানমারের সব সময়ের বন্ধু হিসাবে চীনকে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু মিয়ানমার এখন শুধু চীনের ওপর নির্ভরশীল নয়। বরং সেই অবস্থানের বড় ধরনের পরিবর্তন হয়েছে। দেশটি অসাধারন কূটনৈতিক দক্ষতা ও বানিজ্যক স্বার্থকে কাজে লাগিয়ে আরো বিভিন্ন দেশের বন্ধুত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে আর্ন্তজাতিক পরিমন্ডলে এত দিন মিয়ানমার যে বিচ্ছিন্নতা বোধ করতো এখন তা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে।


রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে চীন মধ্যস্থতার উদ্যেগ নিলেও তা কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। এখন মিয়ানমার আর্ন্তজাতিক ফোরামে রোহিঙ্গা সংকটের জন্য উল্টো বাংলাদেশকে দোষারোপ করছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে ভারতের সামরিক সহযোগিতার সম্পর্ক বেড়ে যাওয়ায় রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে মিয়ানমারের আচরণ নিয়ে ভারত কখনও কড়াভাবে সমালোচনা করেনি। মিয়ানমার সফরকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং প্রেসিডেন্ট রামনাথ কোভিন্দ রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কোন উদ্বেগ জানাননি। বিস্ময়কর দিক হলো চীন ও ভারত উভয়ই বাংলাদেশের বন্ধু। মিয়ানমারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বোঝা এখন বাংলাদেশের কাধে। কিন্তু এই দুদেশকে বাংলাদেশ পাশে পাচ্ছে না।