দশ দেশ আর দুই সাগর পাড়ি দিয়ে চীনের ট্রেন যখন ইউরোপে

তুরস্কে চীনের ট্রেন - আনাদুলু

  • আলফাজ আনাম
  • ১৩ নভেম্বর ২০১৯, ০১:০৩


চীন থেকে ইউরোপে যাচ্ছে মালবাহী ট্রেন। অবিশ্বাস্য মনে হলেও চীনের পন্য নিয়ে এই ট্রেন যোগাযোগ শুরু হয়ে গেছে। বসফরাস প্রনালীর নীচ দিয়ে মারমারি টানেল দিয়ে এশিয়া থেকে ইউরোপে প্রবেশ করে ট্রেনটি। চায়না একসপ্রেস ট্রেনটি আংকারা স্টেশনে এসে থামে তখন এক অনুষ্টানের আয়োজন করা হয়। যেখানে তুরস্কের যোগাযোগ ও পরিবহন মন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের জন্য এ অঞ্চলে চীনের বিনিয়োগের পরিমান ৭৫৪ বিলিয়ন ডলার। তুরস্কের মন্ত্রী স্পষ্ট ভাবে জানান চীনের এই প্রকল্পের সাথে তুরস্ক নিজেকে সম্পৃক্ত করেছে। যোগাযোগের মিসিং লিংকগুলো পুর্ননিমান করা হয়েছে।


তুরস্কের মন্ত্রীর মতে ভৌগলিক অবস্থান, ইতিহাস এবং সংস্কৃতি সহ তুরস্কের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিকাশে একটি দুর্দান্ত ভূমিকা রাখবে এই প্রকল্প। এশীয়, ইউরোপীয়, বলকান, ককেশাস, মধ্যপ্রাচ্য, ভূমধ্যসাগর এবং কৃষ্ণ সাগর দেশগুলির সাথে যোগাযোগ স্থাপন করবে। তিনি বলেন বাকু-তিবলিসি-কারস রুটে প্রথম যাত্রা করা চীন রেলওয়ে এক্্রপ্রেস রেলপথ পরিবহনে এক নতুন যুগের সুচনা করছে। এই রেল যোগাযোগর কারনে তুরস্ক থেকে চীনে পন্য পরিবহন ৩০ দিন থেকে কমে ১২ দিনে এসেছে। এখন এশিয়া থেকে লন্ডন পন্য পরিবহন করতে ১৮ দিন লাগবে। চীনের শিয়ান থেকে ট্রেনটি ইলেকট্রনিক পন্য নিয়ে ১০টি দেশ, দুটি সাগর ১১ হাজার ৪৮৩ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ১২ দিনে তুরস্কে পৌছায়। এই ট্রেনটির শেষ গন্তব্য চেক প্রজাতন্ত্রের প্রাগে।


এক অঞ্চল, এক পথ বা ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড চীন সরকারের একটি উন্নয়ন কৌশল । মুলত আন্ত:রাষ্ট্র ও আন্তমহাদেশীয় অবকাঠামো প্রকল্প। এর আরেক নাম পুরানো সিল্করোড বা রেশম পথের পুুরুজ্জীবন। চীনের মূল সিল্ক রোডের অস্তিত্ব ছিল প্রায় দুই হাজার বছর আগে। এটি ছিল বাণিজ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পথ। এর মধ্য দিয়ে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের মধ্যে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চিন্তাধারার বিনিময় হয়েছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং ২০১৩ সালে সিল্ক রোড পুনরুজ্জীবনের এই ধারনা উপস্থাপন করেন।


ঐতিহাসিক সিল্করোডের পরিধির বাইরেও কয়েক ভাগে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। উত্তর বেল্ট সড়ক ও রেলপথ যাবে চীন হয়ে মধ্য এশিয়া, রাশিয়া এবং ইউরোপের মধ্য দিয়ে। কেন্দ্রীয় বেল্ট চীন থেকে মধ্য এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া হয়ে পারস্য উপসাগর এবং ভূমধ্যসাগরে যাবে। দক্ষিণ বেল্ট চীন থেকে শুরু হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্য দিয়ে ভারত মহাসাগরে শেষ হবে।


এই প্রকল্পের আওতায় উপকূলবর্তী সিল্ক রোড, যা "টুয়েন্টি -ফার্স্ট সেঞ্চুরি মেরিটাইম সিল্ক রোড" নামেও পরিচিত বিনিয়োগ প্রকল্প রয়েছে। যার লক্ষ্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ওশেনিয়া, এবং উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন সমুদ্র বন্দরকে এই প্রকল্পের সাথে সম্পৃক্ত করা। যার মধ্যে দক্ষিণ চীন সাগর, দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর, এবং ভারত মহাসাগর এলাকা রয়েছে।


এই প্রকল্পের অংশ হিসাবে আরব সাগরে পাকিস্তানের গোয়াদর, বঙ্গোপসাগরে মিয়ানমারের কিয়াকপিউ, এবং ভারত মহাসাগরে শ্রীলংকার হাম্বানতোতোয় চীন গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মান করেছে। এছাড়া বাংলাদেশের সোনাদিয়ায় চীন আরেকটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মানের আগ্রহ দেখিয়ে আসছে।


বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের আওতায় পূর্ব আফ্রিকায় স্থানীয় বন্দর গুলো উন্নয়নে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে চীন। গড়ে তোলা হয়েছে সড়ক ও রেল নেটওয়ার্ক। চীনের বিনিয়োগে নাইরোবি এবং কাম্পালার মধ্যে একটি আধুনিক মান-গেজ রেললাইন নির্মাণ করা হয়েছে। এর ফলে পূর্ব আফ্রিকা বিশেষ করে তাঞ্জানিয়ার জানজিবার দ্বীপ মেরিটাইম সিল্ক রোডের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠছে। কেনিয়াতেও একই ভাবে অবকঠামো নির্মান করা হচ্ছে। মোম্বাসা বন্দর এবং নাইরোবির মধ্যে সংযোগকারী ২৭০০ কিলোমিটারের একটি রেলপথ লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।


চীনের এই বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের সাথে প্রাথমিক ভাবে এশিয়া ও ইউরোপের প্রায় ৬০ টি দেশ সম্পৃক্ত হওয়ার কথা জানিয়েছিলো। যার মধ্যে ওশেনিয়া এবং পূর্ব আফ্রিকার দেশও রয়েছে। পরবর্তীতের ১২০টি দেশ এই প্রকল্পের সাথে সম্পৃক্ত হয়। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্যদিয়ে চীনের বানিজ্য সম্প্রসারনের পথ যেমন তৈরি হবে। তেমনি আর্ন্তজাতিক রাজনীতিতে চীনের প্রভাব বাড়ছে। চীনের নেতারা বলছেন একুশ শতকের মহাপরিকল্পনা হিসেবে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রুট’ গড়ে তোলা হয়েছে, বিশ্ব অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে চীনের অবস্থানকে শক্ত করাই যার উদ্দেশ্য। এটির সাফল্যের সাথে জড়িয়ে আছে চীনা নেতাদের হাজার হাজার কোটি ডলারের হিসাব-নিকাশ। সিল্ক রোড প্রকল্পে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে চীন। এ জন্য তারা চার হাজার কোটি মার্কিন ডলারের সিল্ক রোড তহবিল ও ১০ হাজার কোটি ডলারের এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের তহবিল গড়ে তুলেছে।


ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্পের আওতার সাথে সমন্বয় রেখে কিছু সড়ক ও রেল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হচ্ছে। যেমন চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর (সিপিইসি) এবং বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার (বিসিআইএম) ইকোনমিক করিডোর। এছাড়া চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর রয়েছে। ইতোমধ্যে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর দিয়ে বানিজ্য শুরু হয়েছে। চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর কাশগর থেকে কারাকোরাম মহাসড়ক হয়ে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের ওপর দিয়ে কোয়েটায় প্রবেশ করে। এরপর পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের গোয়াদর বন্দর থেকে চীনা পন্য নিয়ে পন্যবাহী জাহাজ আরব সাগরের বন্দরে যাচ্ছে।


মধ্যপ্রাচ্য থেকে জ¦ালানীর ট্যাংকার গুলো এখন ঘুরপথে সংকীর্ন মালাক্কা প্রনালী হয়ে চীনে প্রবেশ করে। গোয়াদর বন্দরের সাথে চীনের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ার মধ্যদিয়ে আরব সাগরে ঢোকার সুযোগ পাচ্ছে চীন। স্বাভাবিকভাবে চীনের জ¦ালানী খরচ সাশ্রয় হচ্ছে একই সাথে চীনা পন্যর বাজার মধ্যপ্রাচ্য আর আফ্রিকার দেশগুলোতে সম্প্রসারনের কাজও সহজ হবে।


এদিকে চীন থেকে তিন দিন করে মোট ১৪ দিনে চীন, রাশিয়া, কাজাখস্তান ও বেলারুশের ওপর দিয়ে ৯ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি পথ পাড়ি দিয়ে ট্রেন যাচ্ছে পোল্যান্ডের ওয়ার’শ ও জার্মানির হামবুর্গে। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ সত্ত্বেও চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পে যোগ দিয়েছে ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ। যার মধ্যে রয়েছে ইতালি।


চীনের এই প্রকল্পের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে চীনের পাশের দেশ নেপাল। হিমালয়ের ভেতর দিয়ে একটি টানেল নির্মানের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। চীনের সাথে নেপালের রেল সংযোগ স্থাপন করবে। এর ফলে ভুবেষ্টিত নেপাল পন্য পরিবহনের সুযোগ পাবে। পাকিস্তান ও নেপালের সাথে বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের এই সংযুক্তি ভারতকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন করতে ফেলতে পারে। এখন পর্যন্ত ভারত এই প্রকল্পের সাথে সংযুক্ত হয়নি। অপরদিকে এই প্রকল্পের আওতায় চীনের কুনমিং থেকে বাংলাদেশ হয়ে পশ্চিম বাংলা পর্যন্ত সড়ক যোগাযোগ স্থাপনে চীন যথেষ্ট আগ্রহী। যার সাথে চট্রগ্রাম বন্দরকে সংযুক্ত করা সম্ভব হবে।


চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোডের গুরুত্বপূর্ন অংশীদার বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ এই প্রকল্পে সম্পৃক্ত হওয়ার কথা জানিয়েছে। বাংলাদেশের উন্নয়নে চীনের বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কিছুটা চাপের মধ্যে রয়েছে বলে অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন। চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোরের কাজ এগিয়ে গেলেও বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমার হয়ে চীনের সাথে সড়ক যোগাযোগ স্থাপনের গতি এগুচ্ছে না। ককসবাজারের সোনাদিয়ায় চীনা বিনিয়োগে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মানেও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।